যে সাহাবিকে সিরিয়ার প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিলেন ওমর রা.
পৃথিবীতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবির একজন হজরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.। তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবেও প্রসিদ্ধ।
তিনি ছিলেন উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, হালকা-পাতলা গঠন ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী। তীক্ষ্ম মেধাবী, অত্যন্ত বিনয়ী ও লাজুক স্বভাবের ছিলেন তিনি। তবে যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে ধৈর্য-সহ্য ও দৃঢ়তা তাঁর মধ্যে ফুটে উঠত।
মক্কায় ইসলামের প্রথম দিনগুলোতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথম দিকে প্রকাশ্যে ইসলামের কার্যক্রম করা যেতো না। এ সময় দারুল আরকামে গোপনে সাহাবিদের ইসলামের শিক্ষা দিতেন রাসূল সা.।
একদিন রাসূল সা. দারুল আরকামের প্রবেশের পূর্বে ইবনে মাজউন, উবাইদা ইবনে হারিস, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, আবু সামালা ইবনে আব্দুল আসাদ ও আবু উবাইদাহ ইবনে জাররাহ (রা.) রাসুল (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হন। রাসুল (সা.) তাঁদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলামের সৌন্দর্যের কথা তাঁদের সামনে তুলে ধরেন। তখন তাঁরা সবাই একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মক্কার মুশরিকদের নির্যাতনের মুখে তিনি দ্বীন ও ইমান রক্ষায় দুবার হাবশায় হিজরত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পর তিনি সেখানে হিজরত করেন। 'জুল হিজরাতাইন' হিসেবেও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তাঁর বিশেষ মর্যাদার আসন ছিল।
আরও পড়ুন
আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) ছিলেন আল্লাহর অকুতোভয় সৈনিক। বদর, উহুদ, খন্দক, তাবুক, হুনায়েনসহ রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে প্রায় সব যুদ্ধেই তিনি অসীম সাহসিকতায় লড়াই করেছেন কাফিরদের বিরুদ্ধে।
তিনি প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর অত্যন্ত আস্থাভাজন ও প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। আবু উবাইদা (রা.) উভয়ের খেলাফতকালে বিশেষ পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেন।
হজরত আবু বকর রা. রাসূলে করিম সা.-এর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী সিরিয়া অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাদলকে তিন ভাগে ভাগ করে একটি সুপরিকল্পিত অভিযানের প্রস্তুতি নেন।
তিন হাজার সেনার তিনটি বাহিনীর একটি আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে প্যালেস্টাইনের দিকে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দল দুটি যথাক্রমে ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান ও সুরাহবিল ইবনে হাসানের নেতৃত্বে তাবুকের দিকে প্রেরণ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে আবু উবাইদা রা. আরেকটি বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন।
সব মুসলিম বাহিনীর সব অভিযানে বিজয়ের সংবাদে হিরাক্লিয়াস মুসলিম আধিপত্যকে সমূলে বিনাশের লক্ষ্যে দুই লাখ ৪০ হাজার সেনার এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে। তাদের মোকাবিলার জন্য ইয়াজিদ, সুরাহবিল ও আবু উবাইদার নেতৃত্বাধীন তিনটি বাহিনী একত্র হয়। খলিফার নির্দেশে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) তাঁর বাহিনী নিয়ে বসরা থেকে এসে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। সম্মিলিত মুসলিম বাহিনী সেনাসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ হাজার। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুলাই আজনাদাইন প্রান্তরে দুই বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলিম বাহিনী সিরীয় বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে এবং পুরো ফিলিস্তিনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইতিহাসখ্যাত এ যুদ্ধে হজরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) অসীম সাহসিকতা ও রণনৈপুণ্যের পরিচয় দেন। তিনিই এ যুদ্ধে সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন।
৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে সিরিয়ার শাসনকর্তার পদ থেকে অপসারণ করে তাঁর স্থলে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)কে নিয়োগ দেন।
হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) জনগণকে উদ্দেশ করে বলেন, "তোমাদের খুশি হওয়া উচিত, কারণ 'আমিনুল উম্মাহ' তোমাদের ওয়ালি নিযুক্ত হয়েছেন।"
৬৩৭ খ্রি. আবু উবাইদা (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম অবরোধ করে এবং খ্রিস্টান ধর্মগুরু সাফ্রোনিয়াস জিজিয়া কর প্রদানের বিনিময়ে জান, মাল, গির্জা, বাসস্থানের নিরাপত্তা দেওয়ার শর্তে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন।
খ্রিস্টানদের দাবি মতে, আবু উবাইদার আহ্বানে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রধান খলিফা ওমর (রা.) জেরুজালেম আগমন করে চুক্তিপত্রে মুসলমানদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাটের প্ররোচনায় ৩০ হাজার জাজিরাবাসী মুসলিম আধিপত্য নির্মূলে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মুসলিম সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাবিধানে আবু উবাইদা (রা.) তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জাজিরা দখল করে নেন। এভাবে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করে আবু উবাইদা (রা.) মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছিলেন।
এমন সময়ে সিরিয়া অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি চরম আকার ধারণ করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন।