মন্দ পরিণতির জন্য মানুষ নিজেই দায়ী
পৃথিবীর আনাচে কানাচে, সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসে আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য সৃষ্টি। সব সৃষ্টির ওপর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন তিনি। মানুষই সবার মাঝে শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য সৃষ্টি ও মানুষের মাঝে পার্থক্য হলো বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনার ক্ষমতা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সে সব ফেরেশতার সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা বাকারা, আয়াত :৩১)
অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা কি দেখ না, আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন? এমন লোকও আছে; যারা জ্ঞান, পথনির্দেশ ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বাগিবতণ্ডা করে। (সূরা লুকমান, আয়াত :২০)।
অন্যান্য প্রাণীরও জীবন আছে, খাবার, জৈবিক চাহিদা আছে। তবে মানুষের মতো তাদের বিবেচনাবোধ নেই, ভালো মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা নেই। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিশেষভাবে বিবেবচনাবোধ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এ কারণে পরকালে তার কাছ থেকেই পৃথিবীর যাপিত জীবনের সবকিছুর হিসাব চাওয়া হবে। কোনো কিছুতে ছাড় দেওয়া হবে না।
মানুষের আসল ঠিকানা পরকাল। পৃথিবীতে মুহূর্তকালের জন্য তাদের প্রেরণ করা হয়েছে। পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন বস্তু সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষণকালের জীবনে মানুষকেই সবার মাঝে শ্রেষ্ঠ হওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
পৃথিবীর অল্প সময়ের জীবনে স্বেচ্ছাচারীতা না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে। জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কারো ওপর জুলুম নির্যাতন, ত্রাস না চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোরআনে ও হাদিসে। কিন্তু অফুরন্ত ইচ্ছাধীকার পেয়ে যে ব্যক্তি যাচ্ছেতাই জীবনযাপন করে বেড়ায় এবং অন্যের ওপর জুলুম করে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত নিয়ে যান। পরকালে অনন্ত শাস্তি দেন, একইসঙ্গে দুনিয়াতেও তাকে করেন অন্যের শিক্ষার উপকরণ।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
ظَهَرَ الۡفَسَادُ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ اَیۡدِی النَّاسِ لِیُذِیۡقَهُمۡ بَعۡضَ الَّذِیۡ عَمِلُوۡا لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ
মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কোন কোন কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।
‘স্থল’ বলতে মানুষের বাসভূমি এবং জল বলতে সমুদ্র, সামুদ্রিক পথ এবং সমুদ্র-উপকূলে বসবাসের স্থান বুঝানো হয়েছে। ‘ফাসাদ’ (বিপর্যয়) বলতে ওই সকল আপদ-বিপদকে বুঝানো হয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষের সমাজে সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হয় এবং মানুষের শান্তিময় জীবন-যাত্রা ব্যাহত হয়।
এই জন্য এর অর্থ গুনাহ ও পাপাচার করাও সঠিক। অর্থাৎ, মানুষ একে অপরের উপর অত্যাচার করছে, আল্লাহর সীমা লংঘন করছে এবং নৈতিকতার বিনাশ সাধন করছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে।
অবশ্য ‘ফাসাদ’-এর অর্থ আকাশ-পৃথিবীর ওই সকল বিপর্যয় নেওয়াও সঠিক, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ও সতর্কতা স্বরূপ প্রেরণ করা হয়। যেমন দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অনিরাপত্তা, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি।
উদ্দেশ্য এই যে, যখন মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতাকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নেয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিফল হিসেবে তাদের কর্মপ্রবণতা মন্দের দিকে ফিরে যায় এবং তার ফলে পৃথিবী নানা বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সুখ-শান্তি বিলীন হয় এবং তার পরিবর্তে ভয়-ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ছিনতাই-ডাকাতি, লড়াই ও লুটপাট ছড়িয়ে পড়ে।
তবে যাই করে থাকুক মানুষ আল্লাহ তায়ালা মন্দ কাজের জন্য তাকে পরিণতি দিয়েই থাকেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, যখন সময় আসবে তখন অবশ্যই তোমার প্রতিপালক তাদের সবাইকে তার কর্মফল পুরোপুরিভাবে দেবেন। তারা যা করে, নিশ্চয়ই তিনি সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (সূরা : হুদ, আয়াত : ১১১)
অর্থাৎ, মানুষের কৃতকর্মের ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তি নির্ধারিত হবে। মহান আল্লাহর কাছে মানুষের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব কাজই স্পষ্ট। কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই। মানুষের মনের সুপ্ত অভিপ্রায় সম্পর্কেও তিনি অবগত।
সব কিছুর ওপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ আছে। কাজেই শাস্তি ও পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারে তিনিই পূর্ণাঙ্গ ন্যায় ও সমতা রক্ষা করতে সক্ষম। তিনি দুনিয়াতেও এর শাস্তি দিয়ে থাকেন। শিক্ষার উপকরণ হিসেবে। তবে চূড়ান্তভাবে এ প্রতিদান দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পরকালে।
পূর্ববর্তী ঔদ্ধতদের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
قُلۡ سِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَانۡظُرُوۡا كَیۡفَ كَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلُ ؕ كَانَ اَكۡثَرُهُمۡ مُّشۡرِكِیۡنَ
বলুন, তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর অতঃপর দেখ পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে! তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক। (সূরা : মুমিন, আয়াত : ২০)
এখানে বিশেষ করে অংশীবাদী ও মুশরিকদের কথা উল্লেখ হয়েছে। যেহেতু শিরক হল সবচাইতে বড় গোনাহ। এ ছাড়াও এতে অন্যান্য পাপাচার ও অবাধ্যতাও এসে যায়। কারণ, অন্যান্য পাপও মানুষ নিজের প্রবৃত্তি-পূজার ফলেই করে থাকে। তাই মন্দ পরিণতি ভোগের আগে এসব থেকে বিরত থাকা জরুরি।