আসহাবে সুফফা বলা হয় যে সাহাবিদের
আসহাবে সুফফা বলা হয় সাহাবিদের একটি বিশেষ দলকে। যারা আত্মশুদ্ধির, কিতাব, হিকমত শেখার জন্য জন্য দিনরাত রাসূল সা.-এর কাছে থাকতেন। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, সংসার জীবনের প্রতি কোনো আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না।
কিবলা পরিবর্তনের পর মসজিদে নববীর মিহরাব বায়তুল্লাহর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, তখন প্রথম কিবলার দিকটিতে দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়। ওই স্থানটি দরিদ্র, নিঃস্ব সাহাবি যাদের কোনো ঠিকানা বা ঘরবাড়ি ছিল না তাদের অবস্থানের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এই স্থানটি সুফফা নামে প্রসিদ্ধ ছিল।
এখানে ওইসব অসহায় সাহাবি অবস্থান করতেন যারা নিজেদের দারিদ্র্যে ধৈর্যধারণের সঙ্গে সঙ্গে এতো বেশি তৃপ্ত ও আল্লাহর ওপর কৃতজ্ঞ থাকতেন যা ধনী ব্যক্তিদের মধ্যেও ছিল না।
তারা সবসময় এখানে থাকার ফলে রাসূল সা. থেকে বর্ণিত হাদিসের বাণী ও হাদিসে কুদসি সব সময় শুনতে পেতেন। তাদেরকেই ইসলামে আসহাবে সুফফা বলে স্মরণ করা হয়।
আসহাবে সুফফার জীবন যেমন ছিল
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রা. নিজেও আহসাবে সুফফার একজন সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, আমি এমন সত্তরজন আহসাবে সুফফাকে দেখেছি, যাদের চাদর পর্যন্ত ছিল না, শুধু লুঙ্গি অথবা কম্বল ছিল, তারা তা নিজের গলার সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। কম্বলও এতো ছোট ছিল যে, কারো পায়ের গোছার অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছাতো আর কারো টাখনু পর্যন্ত। আর তা তারা হাত দিয়ে ধরে রাখতেন যাতে সতর খুলে না যায়। (বুখারি, ১/৬৩)
হজরত ওয়াসিলা ইবনুল আসকা রা. বলেন, আমিও আসহাবে সুফফার একজন ছিলাম। আমাদের কারো কাছে পূর্ণ একটি কাপড় ছিল না। ঘামের কারণে শরীরে ময়লা জমে যেত। (হিলয়াতুল আউলিয়া, ১/৩৪১)
আসহাবে সুফফা সম্পর্কে মুজাহিদ বলেছেন, হজরত আবু হুরায়রা রা. বলতেন, আমি কখনো কখনো ক্ষুধার যন্ত্রণায় নিজের বুক ও পেট মাটিতে লাগিয়ে রাখতাম। (যেনো মাটির আর্দ্রতা ও শীতলতার কারণে ক্ষুধার যন্ত্রণা কিছুটা কমে।) আর কোনো কোনো সময় পেটে পাথর বাঁধতাম যেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি।
‘আসহাবে সুফফা ছিল ইসলামের মেহমান’
আবু হুরায়রা রা. বলেন, আসহাবে সুফফা ছিল ইসলামের মেহমান। তাদের কোনো ঘর-বাড়ি, সম্পদ ছিল না। মোট কথা তাদের কোনো আশ্রয় ছিল না। রাসূল সা.-এর কাছে যখন কোনো সদকা আসতো তিনি তা আসহাবে সুফফার কাছে পাঠিয়ে দিতেন, নিজের জন্য কিছু রাখতেন না। (কারণ, সদকা নবীর জন্য নিষিদ্ধ ছিল।) আর নবীজির কাছে হাদিয়া এলে তিনি সেখান থেকে কিছু গ্রহণ করে বাকী অংশ আসহাবে সুফফাকে দিতেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে শাকীক বলেন, আমি এক বছর আবু হুরায়রা রা.-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি একদিন বললেন, আহা! যদি তুমি আমাদরে সময়টা দেখতে, যখন পর পর কয়েকদিন আমাদের এমন কাটতো যে, আমাদের একটুও খাবার জুটতো না, যার মাধ্যমে আমরা মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারি। এমন কি মেরুদণ্ড সোজা রাখার জন্য আমরা কোমরে পাথর বাঁধতাম। (ইমাম আহমাদ, ফাতহুল বারি,১১/২৪২)
এক পেয়ালা দুধ
আবু হুরায়রা রা. বলেন——
একদিন আমি রাস্তার মাথায় গিয়ে বসে পড়লাম। এ সময় আবু বকর রা. সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে কোরআনের একটি আয়াতের অর্থ জিজ্ঞেস করলাম। উদ্দেশ্য ছিল, তিনি আমার অবস্থা ও প্রয়োজন বুঝতে পেরে হয়তো আমাকে তার সঙ্গে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পারলেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন।
ওমর রা. সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাকেও জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু তিনিও আমার অবস্থা বুঝতে না পেরে সেখান থেকে চলে গেলেন।
এরপর রাসূল সা. সেই পথে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন এবং তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তখন তাঁর ঘরে এক পেয়ালা দুধ ছিল। তিনি আমাকে বললেন, আসহাবে সুফফার সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো।
রাসূল সা. আসহাবে সুফফাকে ডাকতে বলায় আমি মনে মনে কিছুটা কষ্ট পেলাম। আমার মনে হলো, মাত্র এক পেয়ালা দুধ, এটা দিয়ে কীভাবে পুরো আসহাবে সুফফাকে খাওয়ানো যাবে! অথচ এটা আমি খেতে পারলে আমার শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরে পেতাম। আসহাবে সুফফা এলে রাসূল সা. আমাকে পুরোটাই তাদের মাঝে বন্টন করে দিতে বলবেন, তাদের দেওয়ার পর আমার জন্য আর কিছুই থাকবে না। কিন্তু রাসূল সা.-এর আনুগত্য না করে উপায় ছিল না, তাই আমি আসহাবে সুফফাকে ডেকে আনলাম। তাদের সবাই এই দুধ তৃপ্তি ভরে পান করলেন।
তখন রাসূল সা. আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন এবং বললেন, এখন তুমি আর আমিই বাকি আছি। তুমি তৃপ্তিভরে পান করো। আমি সেই পেয়ালা থেকে তৃপ্তি নিয়ে পান করলাম, আমার পেট ভরে গেল। এরপর আমি সেই পেয়ালা রাসূল সা.-কে দিলাম, তিনিও সেখান থেকে পান করলেন। (বুখারি)
আরও পড়ুন
ধনী সাহাবিদের মেহমান আসহাবে সুফফা
হজরত আব্দুল রহমান ইবনে আবু বকর রা. বলেন, আসহাবে সুফফাগণ নিঃস্ব ছিলেন। রাসূল সা. সাহাবিদের মধ্যে তাঁদের ভাগ করে দিতেন এভাবে যে, যার কাছে দুজনের খাবার আছে সে একজন এবং যার কাছে তিনজনের খাবার আছে সে তিনজননকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। (বুখারি)
মসজিদে নববীর সন্ধ্যা...
মুহাম্মদ ইবনে সীরিন বলেন, যখন সন্ধ্যা হতো রাসূল সা. আসহাবে সুফফার সদস্যদেরকে অন্য সাহাবিদের মাঝে বন্টন করে দিতেন। কেউ দু্জন, কেউ তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আর সাদ ইবনে উবাদা একাই আশিজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন এবং মেহমানদারি করাতেন।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি আসহাবে সুফফার একজন ছিলাম। যখন সন্ধ্যা হতো আমরা সবাই নবী সা.-এর কাছে চলে যেতাম। তিনি একজন, দুজন করে ধনী সাহাবিদের কাছে আমাদের সোপর্দ করতেন। এরপর যারা বাকি থাকতেন তিনি তাদের নিজের সঙ্গে খাবারে অংশগ্রহণ করাতেন। খাবার শেষে রাতে আমরা মসজিদে ঘুমাতাম। (ফাতহুল বারি)
মসজিদে নববীতে ফলের থোকা
মসজিদে নববীর দুটি খুঁটির মধ্যে একটি রশি বাঁধা থাকতো। আনসার সাহাবিরা বাগান থেকে থোকা থোকা ফল এনে আসহাবে সুফফার জন্য সেখানে ঝুলিয়ে রাখতেন। আসহাবে সুফফা তা নামিয়ে খেতেন। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. এর ব্যবস্থাপনা ও দেখাশোনা করতেন। (ওফা-আল ওফা, ১/৩২৪)
হজরত আউফ ইবনে মালিক আশজাঈ রা. বলেন, একদিন রাসূল সা. এলেন, তাঁর হাতে একটি লাঠি ছিল। তিনি দেখলেন, রশিতে একটি নষ্ট থোকা ঝুলে আছে। তিনি সেই নষ্ট থোকায় লাঠি লাগিয়ে বললেন, সদকাকারী চাইলে এর থেকে ভালো থোকা সদকা করতে পারতো। (নাসাঈ)
আরেক হাদিসে রাসূল সা. বলেন, প্রত্যেক বাগানের মালিক একটি করে থোকা এনে দরিদ্রদের জন্য ঝুলিয়ে রাখবে। (ফাতহুল বারি)
হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, প্রতি দশটি থোকার মধ্য থেকে একটি থোকা মসজিদে এনে মিসকীনদের জন্য রেখে দেওয়া জরুরি। (তাহাবি)
ক্ষুধার যন্ত্রণা
হজরত ফুযালা ইবনে উবায়দ রা. থেকে বর্ণিত, কোনো কোনো সময় আসহাবে সুফফা ক্ষুধার যন্ত্রণায় নামাজরত অবস্থায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। বাইরে থেকে কেউ এসে তাদের দেখলে মস্তিষ্ক বিবৃত উম্মাদ মনে করতো।
রাসূল সা. শান্ত্বনার জন্য তাদের কাছে এসে বলতেন, তোমরা যদি জানতে আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কি প্রস্তুত রয়েছে তাহলে তোমরা অবশ্যই কামনা করতে যে আমাদের দারিদ্র ও উপবাস যেন আরও বেড়ে যায়।
আসহাবে সুফফার নাম
আসহাবে সুফফার সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি হতো। তাদের সংখ্যা ৪০০ বলে কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে। তাদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো—
১. হজরত আবু উবায়দা আমির ইবনে জাররাহ রা.।
২. হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির আবু ইয়াকযান রা.।
৩. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.।
৪. হজরত মিকদাদ ইবনে আমর রা.।
৫. হজরত হজরত খাব্বাব ইবনে আরাত রা.।
৬. হজরত বিলাল ইবনে রাবাহ রা.।
৭. হজরত সুহায়ব ইবনে সিনান রা.।
৮. হজরত যায়দ ইবনে খাত্তাব রা.। (ওমর রা.-এর ছোট ভাই)।
৯. হজরত আবু মারসাদ কান্নাজ ইবনে হুসায়ন আদাবি রা.।
১০. হযরত আবু কাবশাহ রা.।
১১. হজরত সাফওয়ান ইবনে বায়যা রা.।
১২. হজরত আবু আবস ইবনে জুবায়র রা.।
১৩. হজরত সালিম রা.।
১৪. হজরত মিসতাহ ইবনে উসাসা রা.।
১৫. হজরত উকাশা ইবনে মিহসান রা.।
১৬. হজরত মাসউদ ইবনে রবী রা.।
১৭. হজরত উমায়র ইবনে আওফ রা.।
১৮. হজরত উয়ায়ম ইবনে সায়েদাহ রা.।
১৯. হজরত আবু লুবাবা রা.।
২০. হজরত সালিম ইবনে উমায়র রা.।
২১. হজরত আবুল বাশঅর কাব ইবনে আমর রা.।
২২. হজরত খুবায়ব ইবনে সায়্যাফ রা.।
২৩. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উনায়স রা.।
২৪. হজরত জুনদুব ইবনে জানাদাহ রা.।
২৫. হজরত উতবা ইবনে মাসউদ হুযালি রা.।
২৬. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.।
২৭. হজরত সালমান ফারসী রা.।
২৮. হজরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা.।
২৯. হজরত আবু দারদা উয়ায়মির ইবনে আমির রা.।
৩০. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়দ জুহানী রা.।
৩১. হজরত হাজ্জাজ ইবনে আমর আসলামী রা.।
৩২. হজরত আবু হুরায়রা দাওসি রা.।
৩৩. হজরত সাওবান রা.।
৩৪. হজরত মুয়াজ ইবনে হারিস রা.।
৩৫. হজরত সায়িব ইবনে খাল্লাদ রা.।
৩৬. হজরত সাবিত ইবনে ওয়াদিয়া রা.।
(সীরাতে মুস্তাফা সা. ৩৮৯-৩৯৫)