যে তরুণ সাহাবিকে গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের দায়িত্ব দিয়েছেন রাসূল সা.
উসামা ইবনে যায়েদ রা. মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন নবুয়তের ৭ম বছরে। তার মায়ের নাম বারাকা আল হাবাশিয়্যা। তবে তিনি উম্মে আইমান নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি রাসূল সা.-এর মা আমিনার দাসি ছিলেন। রাসূল সা.-এর মায়ের ইন্তেকালের পর তিনিই তাঁকে প্রতিপালন করেছিলেন। উসামা রা.-এর বাবা ছিলেন রাসূল সা.-এর বিশ্বস্ত সঙ্গী যায়িদ ইবনে হারিসা রা.।
উসামা রা.-এর জন্মের সময় মক্কায় মুসলমানেরা মুশরিকদের চরম-অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে উসামার জন্মের খবর রাসূল সা.-কে আনন্দিত করেছিল। রাসূল সা.-এর প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণে তাঁর বাবা যায়িদকে ‘হিব্বু রাসূলিল্লাহ’ বলা হতো। তাকেও ‘ইবনুল হিব্ব’ বা রাসূল সা.-এর প্রীতিভাজনের পুত্র উপাধি দেওয়া হলো।
উসামা রা. রাসূল সা.-এর নাতি হাসান রা.-এর সমবয়সী ছিলেন। রাসূল সা. তাদের দুজনকেই সমান ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। তিনি উসামাকে নিজের এক উরু ও হাসানকে আরেক উরুর ওপর বসিয়ে তাদেরকে বুকে আগলে রেখে বলতেন, হে আল্লাহ, আমি তাদের দুজনকে ভালোবাসি, তুমিও তাদের দুজনকে ভালোবাসো।
যৌবনে উসামা রা.-এর তীক্ষ্ণ মেধা, দুঃসাহস, বিচক্ষণতা, পূতঃপবিত্র চরিত্র, তাকওয়া পরহেযাগারী তাঁর প্রতি রাসূল সা.-এর স্নেহ ভালোবাসা বাড়িয়ে তোলে।
কিশোর হওয়ার কারণে বদর, উহুদ, খন্দকের মতো ইসলামের প্রথম যুদ্ধগুলোতে তিনি অংশ নিতে পারেননি। ৮ম হিজরিতে তিনি প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। এরপর তিনি হুনাইনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের সময় রাসূল সা. সঙ্গী ছিলেন। রাসূলের সঙ্গে একই বাহনে চড়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন।
তার বাবা যায়িদ বিন হারিসা রা. মুতার যুদ্ধে শহিদ হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। তিনি নিজ চোখে বাবাকে শহিদ হতে দেখেন। তবে তিনি এসব দেখে মুষড়ে পড়েননি। বরং খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা.-এর নেতৃত্বে রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এই যুদ্ধে তাঁর বাবা যেই ঘোড়ার ওপর শহিদ হয়েছিলেন তিনি সেই ঘোড়াতে চড়েই মদিনায় ফিরে আসেন।
একাদশ হিজরিতে রাসূল সা. রোমান বাহিনীর সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সেনা বাহিনী প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। হজরত আবু বকর, ওমর, সাদ ইবনে আদি ওয়াক্কাস, আবু উবাইদা ইবনুল জাররা প্রমুখ প্রথম কাতারের সমর বিশারদ সাহাবিগণ এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। রাসূল সা. উসামা বিন যায়িদকে এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর ছিল।
রাসূল সা. গাজা উপত্যকার কাছে বালকার আশেপাশের সীমান্তে ছাউনি ফেলার নির্দেশ দিলেন।
বাহিনী প্রস্তুত হলো। কিন্তু এ সময় রাসূল সা. অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর রোগ বেড়ে গেল। উসামা রা.-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনী মদিনার উপকণ্ঠে জুরুফ নামক স্থানে প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সেখান থেকে প্রতিদিন তিনি রাসূল সা.-কে দেখতে আসতেন।
তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.-কে দেখতে গেলাম। তিনি অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারছিলেন না। আমাকে দেখে প্রথমে আসমানের দিকে হাত উঠালেন, তারপর আমার শরীরে হাত রাখলেন। আমি বুঝলাম তিনি আমার জন্য দোয়া করছেন।
আরও পড়ুন
রাসূল সা.-এর ইন্তিকাল হলে তিনি জানাজায় অংশ করেন এবং রাসূলকে কবরে নামানোর সৌভাগ্য লাভ করেন।
রাসল সা. এরপরে আবু বকর রা. খলিফা নির্বাচিত হলেন। তিনি উসামা রা.-এর বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এ সময় কিছু সাহাবি উসামার থেকে কিছুটা বয়স্ক কাউকে সেনাপতি নিয়োগের অনুরোধ জানালেন। তবে আবু বকর রা. রাসূল সা.-এর নিযুক্ত সেনাপতিকে অপসারণে কোনোভাবে রাজি হলেন না।
উসামা রা. রাসূল সা.-এর নির্দেশ মতো ফিলিস্তিনের বালকায় সীমান্ত ঘাঁটি গাড়লেন। এতে করে সেখান থেকেই মুসলমানদের মন থেকে রোমান বাহিনীর প্রতি ভীতি দূর হয়ে যান এবং এর কারণে সিরিয়া, মিসর, উত্তর আফ্রিকা, কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
এ অভিযানে উসামা রা. তাঁর বাবার হত্যাকারীকে হত্যা করেন। যেই ঘোড়ার ওপর তার বাবা শহিদ হয়েছিলেন সেটির পিঠে বিপুল পরিমাণ গনিমতের সম্পদ বোঝাই করে বিজয়ী বেশে মদিনায় ফেরেন। খলিফা আবু বকর রা. মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের বিরাট একটি দল নিয়ে মদিনার উপকণ্ঠে তাঁকে স্বাগত জানান।
মদিনায় পৌঁছে তিনি মসজিদে নববীতে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে বাড়িতে যান।
ঐতিহাসিকরা এ বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, উসামার বাহিনী অপেক্ষা অধিক নিরাপদ ও গনিমতের অধিকারী অন্য কোনো বাহিনী আর দেখা যায়নি।
(আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ১/১৭৪)