শুয়াইব আ. নিজ সম্প্রদায়কে যে আহ্বান জানিয়েছিলেন
আল্লাহ তায়ালা মাদইয়ানবাসীর কাছে শুয়াইব আ.-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তারা ছিল আরবের ওই গোত্র যারা হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী স্থান মাআনে বসবাস করতো তাদের শহরের নাম ছিল মাদইয়ান।
শুয়াইব আলাইহিস সালাম ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের লোক। তিনিও নবীদের রীতিনীতি ও অভ্যাস অনুযায়ী নিজের জাতিকে এক ও শরিকবিহীন আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দেন। এবং কারো হক নষ্ট না করে ওজন ও মাপে কম দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন।
আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সুখী, সমৃদ্ধ ও স্বচ্ছল রেখেছেন। তোমরা তাঁর এই অনুগ্রহের কথা ভুলে যেও না। তিনি তাদের কাছে নিজের শঙ্কার কথা প্রকাশ করে বললেন, তোমরা যদি শিরক ও অত্যাচার থেকে বিরত না থাকো, তাহলে তোমাদের এই ভালো ও স্বচ্ছলতা দূরাবস্থায় পরিবর্তিত হবে।
তিনি তাদেরকে পরস্পর লেনদেনের সময় ন্যায় পরায়ণতার সঙ্গে পুরোপুরি মাপ ও ওজন করার নির্দেশ দেন। তাদের মাঝে ডাকাতি, ছিনতাই, লুটতরাজ প্রভৃতি বদ অভ্যাস ছিল, তাই তিনি তাদের বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসাত্মক কাজ করতে নিষেধ করেন।
তিনি তাদের বলেন, মানুষের হক নষ্ট করে লাভবান হওয়ার থেকে আল্লাহ প্রদত্ত লাভ বহুগুণে শ্রেয়। শাস্তির মাধ্যমে যেমন মানুষ ধ্বংস হয় একইভাবে রহমতের মাধ্যমে মানুষের সব কিছু স্থায়ী হয় এবং অবশিষ্ট থাকে। ঠিকভাবে ওজন করে এবং পুরোপুরিভাবে মাপ করে হালাল উপায়ে যে লাভ হয় তাতেই বরকত থাকে। মানুষকে না দেখিয়ে আল্লাহর জন্য তোমাদের ভালো কাজ করা উচিত।
আরও পড়ুন
শুয়াইব আ.-এর উপদেশের প্রেক্ষিতে মাদইয়ানবাসী তাঁকে ঠাট্টা করে বললো—
তুমি তো দারুণ কথা বলেছো! তোমার ধর্মনিষ্ঠা আমাদেরকে আমাদের পূর্বপুরুষের রীতিনীতি ও পুরাতন উপাসকদের পরিত্যাগ করতে বলছে! আর এটাও মজার কথা যে, আমরা আমাদের নিজেদের সম্পদের মালিক থাকবো না, যা ইচ্ছা তাই করতে পারবো না, কাউকে মাপে, ওজনে কমও দিতে পারবো না!
তাদের এমন কথার প্রেক্ষিতে শুয়াইব আ. বললেন, আমার আল্লাহ আমাকে হালাল রিজিক দিয়েছেন এবং তিনি আমার প্রতি মেহেরবানী করেছেন, তাই তোমাদের ভ্রষ্টতা ও হারাম খাওয়াকে (ওজন ও মাপে কম দেওয়া খাবার) আমি সত্য ও হালাল গণ্য করে তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হই কেমন করে?
তিনি তাদের আরও বললেন, আমার সাথে বৈরিতা তোমাদেরকে যেন এমন কাজে প্ররোচিত না করে যার ফলে তোমাদের ওপর নূহ, হুদ, সালেহ, লূত আ.-এর জাতির মতো শাস্তি নেমে আসে।
শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তিনি তাদের বললেন, তোমরা ইস্তেগফার ও তাওবা কর। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। মহান আল্লাহ নির্দয় নন। নিজের সৃষ্টির সাথে তাঁর কোন শক্রতা নেই। তোমরা যতই দোষ করো না কেন যখনই তোমরা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে লজ্জিত হয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসবে তখনই তাঁর হৃদয়কে নিজেদের জন্য প্রশস্ততর পাবে।
কিন্তু তারা শুয়াইব আ.-এর কথা শুনলো না, উল্টো তাঁকে বললো— তুমি কি বলছো, আমরা তোমার কথা বুঝছি না, তোমার সঙ্গে আমাদের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক না থাকলে আমরা তোমাকে পাথর মেরে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতাম।
তিনি যখন দেখলেন যে, এ সম্প্রদায় নিজ কুফরী ও শিরকের উপর অটল এবং তাদের উপর ওয়ায-নসীহতের কোন প্রভাব পড়ছে না, তখন বললেন, ঠিক আছে তোমরা নিজের পথে চলতে থাক। অতি সত্ত্বর সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী কে এবং লাঞ্ছনাকর শাস্তির উপযুক্ত কে তা অবশ্যই জানতে পারবে।
তারপর আল্লাহ তায়ালা তার চিরন্তন বিধান অনুসারে শুয়াইব আলাইহিস সালামকে এবং তার সঙ্গী-সাথী ঈমানদারগণকে সেই জনপদ হতে অন্যত্র নিরাপদে সরিয়ে নিলেন এবং জিবরাঈল আলাইহিস সালামের এক ভয়ঙ্কর হাঁকে বাকিদের সবাইকে এক নিমেষে ধ্বংস করে দিলেন।
পবিত্র কোরআনে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এভাবে—
وَاِلٰی مَدۡیَنَ اَخَاہُمۡ شُعَیۡبًا ؕ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰہٍ غَیۡرُہٗ ؕ وَلَا تَنۡقُصُوا الۡمِکۡیَالَ وَالۡمِیۡزَانَ اِنِّیۡۤ اَرٰىکُمۡ بِخَیۡرٍ وَّاِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ مُّحِیۡطٍ ٨٤ وَیٰقَوۡمِ اَوۡفُوا الۡمِکۡیَالَ وَالۡمِیۡزَانَ بِالۡقِسۡطِ وَلَا تَبۡخَسُوا النَّاسَ اَشۡیَآءَہُمۡ وَلَا تَعۡثَوۡا فِی الۡاَرۡضِ مُفۡسِدِیۡنَ ٨٥ بَقِیَّتُ اللّٰہِ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ۬ۚ وَمَاۤ اَنَا عَلَیۡکُمۡ بِحَفِیۡظٍ ٨٦ قَالُوۡا یٰشُعَیۡبُ اَصَلٰوتُکَ تَاۡمُرُکَ اَنۡ نَّتۡرُکَ مَا یَعۡبُدُ اٰبَآؤُنَاۤ اَوۡ اَنۡ نَّفۡعَلَ فِیۡۤ اَمۡوَالِنَا مَا نَشٰٓؤُا ؕ اِنَّکَ لَاَنۡتَ الۡحَلِیۡمُ الرَّشِیۡدُ ٨٧ قَالَ یٰقَوۡمِ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ کُنۡتُ عَلٰی بَیِّنَۃٍ مِّنۡ رَّبِّیۡ وَرَزَقَنِیۡ مِنۡہُ رِزۡقًا حَسَنًا ؕ وَمَاۤ اُرِیۡدُ اَنۡ اُخَالِفَکُمۡ اِلٰی مَاۤ اَنۡہٰکُمۡ عَنۡہُ ؕ اِنۡ اُرِیۡدُ اِلَّا الۡاِصۡلَاحَ مَا اسۡتَطَعۡتُ ؕ وَمَا تَوۡفِیۡقِیۡۤ اِلَّا بِاللّٰہِ ؕ عَلَیۡہِ تَوَکَّلۡتُ وَاِلَیۡہِ اُنِیۡبُ ٨٨ وَیٰقَوۡمِ لَا یَجۡرِمَنَّکُمۡ شِقَاقِیۡۤ اَنۡ یُّصِیۡبَکُمۡ مِّثۡلُ مَاۤ اَصَابَ قَوۡمَ نُوۡحٍ اَوۡ قَوۡمَ ہُوۡدٍ اَوۡ قَوۡمَ صٰلِحٍ ؕ وَمَا قَوۡمُ لُوۡطٍ مِّنۡکُمۡ بِبَعِیۡدٍ ٨٩ وَاسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ثُمَّ تُوۡبُوۡۤا اِلَیۡہِ ؕ اِنَّ رَبِّیۡ رَحِیۡمٌ وَّدُوۡدٌ ٩۰ قَالُوۡا یٰشُعَیۡبُ مَا نَفۡقَہُ کَثِیۡرًا مِّمَّا تَقُوۡلُ وَاِنَّا لَنَرٰىکَ فِیۡنَا ضَعِیۡفًا ۚ وَلَوۡلَا رَہۡطُکَ لَرَجَمۡنٰکَ ۫ وَمَاۤ اَنۡتَ عَلَیۡنَا بِعَزِیۡزٍ ٩١ قَالَ یٰقَوۡمِ اَرَہۡطِیۡۤ اَعَزُّ عَلَیۡکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ ؕ وَاتَّخَذۡتُمُوۡہُ وَرَآءَکُمۡ ظِہۡرِیًّا ؕ اِنَّ رَبِّیۡ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ مُحِیۡطٌ ٩٢ وَیٰقَوۡمِ اعۡمَلُوۡا عَلٰی مَکَانَتِکُمۡ اِنِّیۡ عَامِلٌ ؕ سَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ۙ مَنۡ یَّاۡتِیۡہِ عَذَابٌ یُّخۡزِیۡہِ وَمَنۡ ہُوَ کَاذِبٌ ؕ وَارۡتَقِبُوۡۤا اِنِّیۡ مَعَکُمۡ رَقِیۡبٌ ٩٣ وَلَمَّا جَآءَ اَمۡرُنَا نَجَّیۡنَا شُعَیۡبًا وَّالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَہٗ بِرَحۡمَۃٍ مِّنَّا وَاَخَذَتِ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوا الصَّیۡحَۃُ فَاَصۡبَحُوۡا فِیۡ دِیَارِہِمۡ جٰثِمِیۡنَ ۙ ٩٤
আর আমি মাদইয়ানের (অধিবাসীদের) প্রতি তাদের ভাই শু‘আইবকে প্রেরণ করলাম। সে বললঃ হে আমার কাওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া আর কেহ তোমাদের ইলাহ নেই; আর তোমরা পরিমাপে ও ওযনে কম করনা। আমি তোমাদেরকে স্বচ্ছল দেখতে পাচ্ছি, আর আমি তোমাদের প্রতি এমন এক দিনের শাস্তির ভয় করছি যা নানাবিধ বিপদের সমষ্টি হবে।
‘আর হে আমার কওম, মাপ ও ওযন পূর্ণ কর ইনসাফের সাথে এবং মানুষকে তাদের পণ্য কম দিও না; আর যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িও না,
যদি তোমরা মুমিন হও তবে আল্লাহ অনুমোদিত যা বাকী থাকবে তা তোমাদের জন্য উত্তম; আর আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই।
তারা বললঃ হে শু‘আইব! তোমার ধর্মনিষ্ঠা কি তোমাকে এই শিক্ষা দিচ্ছে যে, আমরা ঐ সব উপাস্য বর্জন করি যাদের উপাসনা আমাদের পিতৃ-পুরুষরা করে আসছে? অথবা এটা বর্জন করতে বল যে, আমরা নিজেদের মালে নিজেদের ইচ্ছানুসারে ব্যবস্থা অবলম্বন করি? বাস্তবিকই তুমি হচ্ছ বড় সহিষ্ণু, সদাচারী।
তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আমি যদি আমার রব প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি তাঁর কাছ থেকে আমাকে উৎকৃষ্ট রিযক(১) দান করে থাকেন (তবে কি করে আমি আমার কর্তব্য হতে বিরত থাকব?) আর আমি তোমাদেরকে যা নিষেধ করি আমি নিজে তার বিপরীত করতে ইচ্ছে করি না।(২) আমি তো আমার সাধ্যমত সংস্কারই করতে চাই আমার কার্যসাধন তো আল্লাহরই সাহায্যে; আমি তারই উপর নির্ভর করি এবং তারই অভিমুখী।
আর হে আমার সম্প্রদায়! আমার সাথে বিরোধ যেন কিছুতেই তোমাদেরকে এমন অপরাধ না করায় যার ফলে তোমাদের উপর তার অনুরূপ বিপদ আপতিত হবে যা আপতিত হয়েছিল নূহের সম্প্রদায়ের উপর অথবা হুদের সম্প্রদায়ের উপর কিংবা সালেহের সম্প্রদায়ের উপর; আর লূতের সম্প্রদায় তো তোমাদের থেকে দূরে নয়।
আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তার দিকে ফিরে আস; আমার রব তো পরম দয়ালু, অতি স্নেহময়।
তারা বলল, হে শু’আইব! তুমি যা বল তার অনেক কথা আমরা বুঝি নাএবং আমরা তো আমাদের মধ্যে তোমাকে দুর্বলই দেখছি। তোমার স্বজনবর্গ না থাকলে আমরা তোমাকে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলতাম, আর আমাদের উপর তুমি শক্তিশালী নও।
তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি আমার স্বজনবর্গ আল্লাহর চেয়ে বেশী শক্তিশালী? আর তোমরা তাকে সম্পূর্ণ পিছনে ফেলে রেখেছ। তোমরা যা কর আমার রব নিশ্চয় তা পরিবেষ্টন করে আছেন।
আর হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা নিজ নিজ অবস্থানে কাজ করতে থাক, আমিও আমার কাজ করছি। তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে কার উপর আসবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি এবং কে মিথ্যাবাদী। আর তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।
(আল্লাহ বলেন) আর যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল তখন আমি মুক্তি দিলাম শু‘আইবকে, আর যারা তার সাথে ঈমানদার ছিল তাদেরকে নিজ রাহমাতে এবং ঐ যালিমদেরকে আক্রমণ করল এক বিকট গর্জন। অতঃপর তারা নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। (সূরা হুদ, আয়াত : ৮৪-৯৪)