মহানবী সা.-কে যেভাবে কষ্ট দিয়েছিল তায়েফবাসী
মহানবী সা. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরুর পর তার ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে কুরাইশরা। কুরাইশদের নির্যাতনের সময় ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চাচা আবু তালিব ও নবীজির সহধর্মীনী হজরত খাদিজা রা.।
তারা মহানবী সা.-কে মানসিকভাবে অভয় ও আশ্বাস বাণী দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সবসময়। তাদের ইন্তেকালের পর কুরাইশদের নির্যাতন বেড়ে যায়। এসময় রাসূল সা. মক্কা থেকে ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত তায়েফ গমন করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আজাদকৃত গোলাম ও পালকপুত্র জায়িদ ইবনে হারিসা রা.।
আশা করেছিলেন তায়েফের লোকেরা হয়তো ইসলাম গ্রহণ করবেন। তার এমন প্রত্যাশার দুটি কারণ ছিল— তায়েফের অদূরে বনি সাকিফ গোত্রে মহানবী সা. দুধ পান করেন এবং তায়েফ সর্দারদের একজন কোরাইশ গোত্রে বিয়ে করেছিল।
দুধের আত্মীয় ও গোত্রীয় সম্পর্কের কারণে মহানবী সা. তাদের থেকে সদাচার প্রত্যাশা করেছিলেন।
তায়েফে ১০ দিন তিনি গোপনে, প্রকাশ্যে, একাকী ও সামগ্রিকভাবে দাওয়াত দেন। তিনি বাজারে দাঁড়িয়ে কোরআন তিলাওয়াত করেন এবং ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করেন। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৬২)
কিন্তু তায়েফবাসী তাকে হতাশ করে এবং তারা চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার করে মহানবী সা.-এর ওপর।
আরও পড়ুন
রাসূল সা. তায়েফের নেত্রীস্থানীয়দের ইসলামের দাওয়াত দিলে তারা তা মানতে অস্বীকার করলো এবং তায়েফের সাধারণ মানুষদের মহানবী সা.-এর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ১০৮)
তারা মহানবী সা.-কে তায়েফ ত্যাগের নির্দেশ দিল। মহানবী সা. সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় উচ্ছৃঙ্খল বালকদের তার পেছনে লেলিয়ে দিল। তারা নবীজি সা.-এর দিকে পাথর নিক্ষেপ করে গালাগাল করতে শুরু করল।
তাদের পাথরের আঘাত ও অত্যাচারে মহানবী সা.-এর পুরো শরীরের রক্তাক্ত হয়ে যায়। রক্তে তার জুতা ভরে যায়।
এ সময় জায়িদ রা. অসামান্য আত্মত্যাগ স্বীকার করেন। তিনি মহানবী সা.-এর জন্য ঢাল হয়ে যান। যে দিক থেকে পাথর ছোড়া হচ্ছিল তিনি সেদিক থেকে তাঁকে আগলে রাখছিলেন। ফলে তার মাথার কয়েক জায়গায় কেটে যায়।
তাদের এই অত্যাচারে রাসূলুলুল্লাহ সা. মাটিতে বসে পড়তেন। তখন হতভাগারা তাঁর হাত ধরে উঠিয়ে দিত এবং সামনে চলতে বলত। আর সামনে পা বাড়ালেই পাথর নিক্ষেপ করত। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৪৩; মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৬২)
তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত মক্কার উতবা, রাবিয়া ও শায়বাদের বাগানে আশ্রয় নেওয়া পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা মহানবী সা.-এর পিছু নিয়েছিল। এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর তিনি একটি দোয়া করেন। যা ‘দোয়ায়ে মুস্তাদয়িফিন’ (অসহায় মানুষের দোয়া) নামে পরিচিত।
তিনি তার দোয়ায় বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছেই ফরিয়াদ জানাই আমার দুর্বলতার, আমার নিঃস্বতার এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতার। আপনি দয়ালুদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু। অসহায় ও দুর্বলদের প্রতিপালক তো আপনিই! আমার প্রতিপালকও আপনি। আপনি কার হাতে আমাকে সোপর্দ করেছেন। অনাত্মীয় রুক্ষ চেহারাওয়ালাদের কাছে অথবা এমন শত্রুর কাছে আমাকে ঠেলে দিচ্ছেন, যারা আমার ও আমার কাজের ওপর প্রবল। আপনি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হন তবে এর পরও আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না। তবে আপনার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও আফিয়াত আমার জন্য অধিক প্রশস্ত। হে আল্লাহ, আমি আপনার সত্তার নূরের আশ্রয় প্রার্থী, যা দিয়ে সমগ্র আঁধার আলোকিত হয়ে যায় এবং দ্বিন ও দুনিয়ার সব কিছু পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আপনি আমার ওপর কি অভিশাপ অবতীর্ণ করবেন বা ক্রোধান্বিত হবেন যে অবস্থায় আমি আপনার সন্তুষ্টি কামনা করি। সব শক্তি ও ক্ষমতা শুধু আপনারই। আপনার শক্তি ছাড়া কোনো শক্তি নেই।’
এ সময় আল্লাহ তায়েফের পাহাড়ের ফেরেশতাদের পাঠান। তারা মহানবী সা.-এর কাছে দুই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত তায়েফের অধিবাসীদের পাহাড়ে পিষে ফেলার অনুমতি চাইল। কিন্তু মহানবী সা. তা দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, আমি আশা করি, তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক জন্ম নেবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ১৫৪)