রিবার আধুনিক প্রয়োগ
পবিত্র কোরআন শরিফে ‘রিবা’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় ‘রিবা’কে সুদ বলা হয়। মূলত আরবি ‘রিবা’র মূলমর্ম ও প্রকৃত অর্থপ্রকাশক উপযুক্ত প্রতিশব্দের অভাবে এর অনুবাদ করা হয় উর্দু ও ফার্সী শব্দ ‘সুদ’ দিয়ে।
সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউজারি (usury) বা ইন্টারেস্ট (interest)। ‘রিবা’ পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল ‘রাবউন’ থেকে উদ্ভুত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত হওয়া, সম্প্রসারিত হওয়া, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু আরবির রিবাকে উর্দু ভাষার ‘সুদ’ শব্দ দিয়ে অনুবাদ করলেও এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায় না। বরং উর্দু ‘সুদ’ আরবি ‘রিবা’ এর ব্যাপক অর্থের একটি অংশ মাত্র।
ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাই ‘রিবা’ বা সুদ।
রিবা প্রধানত দুই প্রকার : ১. রিবা নাসিআহ; একে রিবাল করয ও রিবাল কুরআনও বলা হয় ২. রিবাল ফদল; একে রিবাল বাইও রিবাল হাদিসও বলা হয়।
রিবান নাসিআহ : আরবি ‘নাসিআহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীক্ষা করা। ইমাম আবু বকর আল জাস্সাস তার বিখ্যাত তাফসির ‘আহকামুল কুরআনে’ রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে:
هو القرض المشروط فيه الأجل وزيادة مال على المستقرض
‘রিবান নাসিআহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ।’ জাহিলিয়াতের সময় সুদ ছিল, কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রদত্ত ঋণের আসলের উপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত অতিরিক্ত।’ অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে কাউকে মেয়াদি ঋণ দেয়া। যেমন কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে রিবান নাসিআহ বলা হবে। (আহকামুল কোরআন ১/৫৫৭)
প্রখ্যাত মুফাস্সির জারির ইবন আত-তাবারি মুজাহিদের সূত্রে জাহেলি যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণিত হাদিস উল্লেখ করেছেন, ‘জাহিলি যুগে কোনো ব্যক্তি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। অতঃপর সে ঋণদাতাকে বলত, আমি এতো এতো পরিমাণ বেশি দেবো, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও।’ ইমাম ফখরউদ্দিন আর-রাজি জাহিলি যুগের রিবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগে রিবান নাসিআহ ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থ ঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত, কিন্তু মূলধন ঠিক থাকত। অতঃপর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে আসল অঙ্ক ফেরত চাইত। ঋণগ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।’ এ ছাড়া হাদিসে রিবা বা সুদের সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছে, ‘যে ঋণ মুনাফা টেনে আনে তাই রিবা বা সুদ।’
আরও পড়ুন
রিবাল ফদল: আরবি ‘ফদল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কমবেশি করে আদায় করার নাম রিবাল ফদল। অর্থাৎ, একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে একপক্ষ আরেক পক্ষের নিকট থেকে চুক্তি মোতাবেক শরিয়ত সম্মত বিনিময় ব্যতিত যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবাল ফদল বলে।
যেমন, এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দেড় কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা। রিবাল ফদলকে মালের সুদও বলা হয়।
হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে, তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। কমবেশি করলে বা বাকিতে করলে, তা সুদী কারবার বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী বিবেচিত হবে।’ (বুখারি, মুসলিম)
প্রথম মূলনীতি: সমজাতীয় বস্তু পরস্পরে বিনিময়ের সময় প্রথম মূলনীতি হচ্ছে পণ্যের গুণগত মানে তারতম্যের কারণে মূল্যের যে পার্থক্য দেখা দেয় তা আমলে না নিয়ে সমান সমান পরিমাণে আদান-প্রদান করা।
দ্বিতীয় মূলনীতি: এ জাতীয় দুটি পণ্য সরাসরি পরস্পরে বিনিময় না করে একজন তার বস্তুকে মূল্যের বিনিময়ে বিক্রয় করে দিবে আর অপরজন তা বাজারের মূল্যে খরিদ করে নিবে।
তৃতীয় মূলনীতি: শিল্পায়নের কারণে যদি দুটি বস্তুর প্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে তবে পরিবর্তনের পরিমাণ বেশি হলে একটির সঙ্গে অন্যটির কমবেশি করে লেনদেন করা বৈধ হবে। আর যদি পরিবর্তন না হয় অথবা সামান্য হয় সে ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে একটির সাথে আরেকটি লেনদেন করলে সমান সমান করে লেনদেন করা। যাতে শোষণের কৃপ্রবৃত্তি জাগ্রত না হয়।
শিল্পায়নের মাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার উদাহরণ-যেমন লোহাকে ইঞ্জিনে পরিণত করা বা তুলাকে বস্ত্রে পরিণত করা ইত্যাদি।
সাধারণ পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন সোনা দিয়ে সোনার চুরি বা চিরুনি তৈরি করা ইত্যাদি।
প্রথমোক্ত অবস্থায় যদি প্রচুর পরিমান লোহা দিয়ে ছোট আকারের একটি ইঞ্জিন খরিদ করে বা প্রচুর পরিমাণ তুলা দিয়ে অল্প কিছু বস্ত্র খরিদ করে তবে জায়েজ হবে।
দ্বিতীয় অবস্থায় চিরুনির সমপরিমাণ সোনা দিয়েই সোনার তৈরি চিরুনি খরিদ করতে হবে অথবা টাকার বিনিময়ে ক্রয় করতে হবে।
চতুর্থ মূলনীতি: সমজাতীয় বস্তু পরস্পরের বিনিময় এর তৃতীয় মূলনীতি
যদি কোন দ্রব্য কে তার ভিন্ন জাত দ্রব্যের সাথে বিনিময় করা হয় তাহলে কমবেশি তো যায় কিন্তু বাকিতে বিক্রয় করা জায়েজ নেই। যেমনঃ 1 কেজি কিলো গম 2 কেজি খেজুরের বিনিময় অথবা একতলা সোনা চারতলা রুপার বিনিময় বিক্রি করা জায়েজ। তবে এই শর্তে যে লেনদেনটি নগদে হতে হবে। এ শর্ত আরোপ করার কারণ হলো যদি নগদ লেনদেন করা হয় তাহলে অবশ্যই তা বাজার দর অনুযায়ীই হবে। যেমন কেউ যদি রুপা দিয়ে স্বর্ণ খরিদ করে তাহলে স্বর্ণের বিনিময়ে সে এতটুকু রুপা হস্তান্তর করবে যতটুকু বাজার দর অনুযায়ী ওই স্বর্ণের সমপরিমাণ হয়।
পক্ষান্তরে যদি এই লেনদেন বাকিতে করা হয় তাহলে সুদ মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে কোন ক্রমেই মুক্ত নয় বিধায় এই জাতীয় লেনদেন বাকিতে করতে নিষেধ করা হয়েছে।
একই দেশের কারেন্সি আদান প্রদানের ক্ষেত্রে সমান সমান হওয়া জরুরি। কম-বেশি করলে তা সুদ হয়ে যাবে। তাই পুরাতন ১০০ টাকার পরিবর্তে নতুন ৯০ টাকার লেনদেন যেমন নাজায়েয, তেমনি ৯০ টাকার মধ্যে ১০ টাকা কয়েন দিয়ে আদায় করলেও নাজায়েয হবে। আর এই মাসআলার সাথে প্রশ্নোক্ত পরবর্তী মাসআলার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, প্রথমত নগদ লেনদেনে টাকা ভাংতির ক্ষেত্রে কম-বেশি করা তো নাজায়েয, কিন্তু এটি যদি জায়েযও হতো তবুও ঋণের বিষয়টিকে এর সাথে মিলানোর কোনো সুযোগ ছিল না। কেননা, ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত কোনো কিছু নেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। এটা ‘রিবা নাসিয়াহ’র অন্তর্ভুক্ত। তাই এক্ষেত্রেও ১০০০ টাকা ঋণের পরিবর্তে ৯০০ টাকা নিয়ে বাকি ২০০ টাকার কয়েন নিলেও তা সুদের শামিল।
-সুনানে আবু দাউদ ৪৭৩, বাযলুল মাজহুদ ৪/২৩৯, ফাতহুল কাদীর ৬/১৪৭, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৪৯, বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যা মুআসারা ১/১৯১ রদ্দুল মুহতার ৫/১২৮
রিবান নাসিআহর প্রচলিত কয়েকটি রূপ
১. সুদী ব্যাংক: বাংলাদেশের সুদী ব্যাংকগুলোর অন্যতম প্রধান কার্যক্রম সাধারণ স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া ও বেশি সুদে ঋণ দেয়া। সুদী ব্যাংকগুলো সুদের কার্যক্রমে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে না। আরও নানা কার্যক্রম করে থাকে। তাই ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত হলো সুদী ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্ট ছাড়া বাকি সব একাউন্ট সুদী একাউন্ট। চাই তা DPS হোক বা FDR হোক অথবা সাধারণ ফিক্সড ডিপোজিট হোক; সবই রিবান নাসিআহ একাউন্ট। তবে ইদানিং SND কারেন্ট একাউন্ট নামে এক ধরনের একাউন্ট বের হয়েছে। তাতে সুদের মিশ্রণ দেয়া হয়। এ ধরনের সুদী একাউন্ট খোলাই গুনাহ। কারণ সুদের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া গুনাহ। আর সুদ গ্রহণ করলে তো সুদ খাওয়ার গুনাহ হয়ই।
২. সুদী ব্যাংকের লোন: তাছাড়া সুদী ব্যাংকগুলোবিভিন্ন নামে লোন দিয়ে থাকে। যেমন কার লোন, হোম লোন, হাউজ লোন, ইনভেস্টমেন্ট লোন, সিসি লোন, কৃষি লোন, স্টুডেন্ট লোন ইত্যাদি। এগুলো সবই রিবান নাসিআহ। কারণ এ ধরনের লোনে ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করা হয়।
২. প্রচলিত প্রাইজবন্ড : বর্তমান প্রচলিত প্রাইজবন্ডে রিবান নাসিআহ রয়েছে। কারণ যে টাকা দিয়ে প্রাইজবন্ড কেনা হচ্ছে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ঋণ হিসেবে আছে। সুতরাং প্রাইজবন্ড ছাড়ার পর একটি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর ড্র করার মাধ্যমে বিজয়ীদেরকে যে পুরুস্কার দেয়া হয় তা ঋণের বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে বিধায় তা রিবান নাসিআহ বা সুদ। {ফাতওয়ায়ে উসমানী-৩/১৭৩-১৭৬}
৩. জমি বন্ধক : বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই জমি বন্ধকের নিয়মটি চালু আছে।জমির মালিক জমি প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। বিনিময়ে টাকার মালিক বন্ধক জমিটি ভোগ করে এবং মেয়াদান্তে পুরো টাকা ফেরত পায় এবং জমির মালিক তার জমি হস্তগত করে নেয়। এখানে জমির মালিক জমি বুঝে পায় আর টাকার মালিক টাকা বুঝে পায় কিন্তু মাঝখানে টাকার মালিক ঋণ দেয়ার কারণে যে জমিটি ভোগ করল সেটি নিঃসন্দেহে রিবান নাসিআহ এর অন্তভুর্ক্ত, যা হারাম। এধরনে বন্ধক বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে প্রচলিত থাকলেও সবগুলোর হুকুম একই। ঋণদাতার জন্য বন্ধকি জমি ভোগ করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ।
উল্লেখ্য, উক্ত কারবার বৈধভাবে করতে চাইলে শুরু থেকেই বন্ধকি চুক্তি না করে ভাড়া বা লীজ চুক্তি করবে। যার বিবরণ হলো, জমির মালিক জমি ভাড়া দেবে। তার যত টাকা প্রয়োজন সেজন্য যত বছর ভাড়া দিতে হয় একত্রে তত বছরের জন্য ভাড়া দেবে এবং অগ্রিম টাকা নিয়ে নেবে। যেমন, এক বিঘা জমির বার্ষিক ভাড়া ৫ হাজার টাকা। মালিকের ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাহলে সে ৪ বছরের জন্য জমি ভাড়া দেবে। এক্ষেত্রে অগ্রিম ২০ হাজার টাকা নিয়েনেবে। এক্ষেত্রে জমির ভাড়া স্থানীয়ভাড়া থেকে সামান্য কম বেশিও হতে পারে। এরপর ভাড়ার মেয়াদ শেষ হলে অর্থ দাতা জমি ফেরত দেবে, কিন্তু প্রদেয়টাকা ফেরত পাবে না।
৪. ডি. পি. এস/ DPS ডিপোজিট পেনশন স্কীম : এটিও সম্পূর্ণ সুদী একাউন্ট।
৫. ক্রেডিট কার্ড : ক্রেডিট কার্ড মূলত এক প্রকার সুদভিত্তিক লোন কার্ড। কেননা এই কার্ডের চুক্তিপত্রেই লেখা রয়েছে যে, মিনিমাম ডিউ টাইমে/ডেটে বাকী পরিশোধ না করলে প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হবে। যার ফলে অধিকাংশ ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারই সুদের আওতায় পড়ে যান। এই সুদ রিবাদ দাইনের অন্তর্ভুক্ত, যা রিবা নাসিয়্যাহ। তাই সুদ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই যথাসময়ে বাকী পরিশোধ করে দিতে হবে। তাহলে আর সুদী কারবার হবে না।
৬. ক্রেডিট কার্ড দ্বারা এটিএম থেকে টাকা উত্তোলন করলে যে চার্জ নেওয়া হয় তা সুস্পষ্ট সুদ। কেননা কার্ডের ফি তো নিচ্ছেই। এখন অতিরিক্তটা ঋণের বিনিময়ে হচ্ছে।
৭. বন্ড : সরকারী এবং বেসরকারী বন্ড। এগুলো সম্পূর্ণ রিবা নাসিয়্যাহ। সরকারী হওয়ার কারণে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো বাণিজ্যিক প্রকল্প, কোনো কোম্পানী বা রাস্তা-ঘাট কিংবা ব্রীজ নির্মাণের জন্য ঋণ নেওয়া হচ্ছে এমন কথা উল্লেখ করার কারণে কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, এটা সুদী হবে না, কিন্তু এ ধারণা ভুল। স্টক এক্সচেঞ্জ বা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য যে কোনো ব্যাংকে যে বন্ড ক্রয়-বিক্রয় হয় তাতে সুনির্দিষ্ট সুদের ঘোষণা দেওয়া থাকে। এ সকল বন্ডও সুদী বন্ড।
৮. স্টুডেন্ট লোন : বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃক স্টুডেন্ট লোন দিয়ে যা অতিরিক্ত নেওয়া হয় সেটাও সুদ। এটি ইন্টারেস্ট বা সার্ভিস চার্জ যে নামেই নেওয়া হোক না কেন।
৯. লটারী : রেডক্রিসেন্ট বা এজাতীয় সরকার অনুমোদিত কিছু প্রতিষ্ঠান দশটাকা বিশটাকা মূল্যের লটারী টিকেট ছাড়ে। এক লক্ষ, দুই লক্ষ টাকা, গাড়ি, মোটর সাইকেল ইত্যাদি পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা নেয়া হয়।
এক্ষেত্রে পুরস্কার পায় কেবল দু’তিনজন। আর বাকিরা কিছুই পায় না। তাদের মূল টাকাই গচ্চা যায়। এধরনের লেনদেনকেই শরীয়তের ভাষায় ‘কিমার’ বলে। যা সম্পূর্ণ হারাম। আর এক্ষেত্রে সবাই তো অতিরিক্ত পাওয়ার উদ্দেশ্যেই দশ-বিশ টাকায় লটারি ক্রয় করে থাকে। যদিও কেউ পুরস্কার পায় আর কেউ পায়া না। তাই এতে সুদও বিদ্যমান।
১০. পোস্ট অফিসের সঞ্চয়পত্র : পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সরকারীভাবে বিভিন্ন নামের সঞ্চয়পত্র স্কীম রয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটি সম্পূর্ণ সুদী, রিবা নাসিয়্যাহ-এর অন্তর্ভুক্ত।
১২. বাড়ি বন্ধক : জমি বন্ধকের মত ঢাকা শহরে বাড়ি বন্ধকের প্রথা চালু হয়েছে। তা হল, বাড়িওয়ালা নিজ প্রয়োজনে ৫ বা ১০ লক্ষ টাকা ঋণ নেয়। বিনিময়ে পাঁচ বছর বা দশ বছর ঋণদাতাকে তার ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় থাকার সুযোগ দেয়। পরবর্তীতে যখন ঋণ পরিশোধ করে দিবে তখন এই চুক্তি সমাপ্ত হবে। এই লেনদেনও সম্পূর্ণ সুদী ও রিবা নাসিয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত। যা সুস্পষ্ট হারাম। কেননা ঋণের কারণেই এ সুবিধা পাচ্ছে।
১৩. বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে সিকিউরিটি বেশি দিলে ভাড়া কমিয়ে দেওয়া : বাড়ি বন্ধকের উপরোক্ত পদ্ধতি নাজায়েয হওয়ার কারণে অনেকে হীলা হিসাবে এ পদ্ধতি চালু করেছে। যেমন, কোনো বাড়িওয়ালার টাকার প্রয়োজন । যেখানে সাধারণ হিসেবে অগ্রিম নেয়ার কথা ২০ হাজার টাকা, কিন্তু এর স্থলে বাড়িওয়ালা পাঁচ লক্ষ টাকা সিকিউরিটি মানি দাবি করে এবং এর বিনিময়ে ভাড়া কমিয়ে দেয় (যেমন, সাধারণ হিসেবে ভাড়া যদি হয় ১০ হাজার টাকা এক্ষেত্রে ভাড়া হবে ১/২ হাজার টাকা)- এটাও হারাম। কেননা ৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়ার কারণেই মূলত তার থেকে ভাড়া কম নিচ্ছে। এই ঋণকে ছুতা হিসেবে সিকিউরিটি মানি বলা হয়েছে। মূলত সিকিউরিটি মানি তো সেটাই যা সচরাচর সবাই দিয়ে থাকে। যা দিলে ভাড়া কমানো হয় না। ভাড়া স্বাভাবিকই থাকে। নাম যাই দেওয়া হোক ফেরতযোগ্য ৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়ার কারণেই ১০ হাজার টাকার ভাড়া ১/২ হাজারে নেমে এসেছে।
ফাযালা বিন উবাইদ রা. বলেন, যেই ঋণ কোনো মুনাফা নিয়ে আসে তা রিবার প্রকারসমূহের একটি। -সুনানে বাইহাকী ৫/৩৫০
ইমাম মালেক রাহ. বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, যে ব্যক্তি কোনো বস্তু ঋণ দিবে সে যেন অতিরিক্ত কোনো কিছু শর্ত না করে। যদিও এক মুঠো ঘাস হোক না কেন। -মুআত্তা মালেক, হাদীস ২৫১৩
১৪. ঐচ্ছিক প্রভিডেন্ট ফান্ড : সরকারী বা বেসরকারী ঐচ্ছিক প্রভিডেন্ট ফান্ড সুদী ফান্ড। ঐচ্ছিক হওয়ার কারণে এতে টাকা জমা দেওয়ার অর্থ ঋণ দিয়ে পরবর্তীতে অতিরিক্ত নেওয়া। আর এটাই রিবা নাসিয়্যাহ। আর পুরো সরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রভিডেন্ট ফান্ডের বাধ্যতামূলক যে অংশ এই ফান্ডে কেটে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে এর সাথে অতিরিক্ত যে অংশ দেওয়া হয় তা সুদ নয়। তা নেওয়া জায়েয। তবে সরকারী প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক কেটে রাখার পাশাপাশি ঐচ্ছিকও কিছু কাটানোর সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকের অতিরিক্ত অংশ কাটানো সুদী চুক্তির অন্তর্ভুক্ত এবং এই অতিরিক্ত কর্তিত অংশের উপর উদ্বৃত্ত যা দিবে তা সুদ। তা নেওয়া বৈধ হবে না। তাই বাধ্যতামূলকের অতিরিক্ত উক্ত ফান্ডে জমা রাখাও জায়েয হবে না। কেননা ঐচ্ছিক অংশ রাখার অর্থই হল সুদী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া। এছাড়া স্বায়ত্ত¡শাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রভিডেন্ট ফান্ডের সকল টাকা সুদী ব্যাংক বা বীমাতে রেখে বৃদ্ধি করা হয়। পরবর্তীতে সেটিই তাদেরকে দেওয়া হয়। তাই এসকল প্রতিষ্ঠানের ঐচ্ছিক ও বাধ্যতামূলক প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমার অতিরিক্ত নেওয়া জায়েজ হবে না। কেননা সেগুলোও সুদের অন্তর্ভুক্ত।
১৫. লাভের হার নির্ধারণ না করে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা প্রদানের শর্তে বিনিয়োগ করা: ব্যাংক ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবসায়ীদেরকে ব্যবসার জন্য টাকা প্রদান করে লাভ হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার শর্ত করা হয় এটাও সম্পূর্ণ সুদী লেনদেন ও সুদী বিনিয়োগ। ব্যবসার জন্য দেওয়া আর লাভ দেওয়ার কথা হলেই অনেকে মনে করেন তা ইসলামী হয়ে যায়; সুদী থাকে না। অথচ ব্যবসার জন্য টাকা দিয়ে নির্ধারিত অংকের কিছু দেওয়ার চুক্তি বা শর্ত করাই সুদ ও রিবা নাসিয়্যাহ। এক্ষেত্রে হালালভাবে বিনিয়োগ করতে চাইলে ব্যবসার প্রকৃত লাভের শতকরা হার নির্ধারণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে লাভ হলে নির্ধারিত অংশ অনুযায়ী ভাগ পাবে। আর লাভ না হলে পাবে না।
কিন্তু পূর্বোক্ত লেনদেনে লাভ হিসেবে নির্দিষ্ট কিছু দেওয়ার কথা হলে চুক্তি অনুযায়ী সে তা দিতে বাধ্য থাকে। লাভ হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় তাকে তা দিতেই হয়। এটাই সুদ। তদ্রƒপ কোনো কিছু নির্দিষ্ট না করে এমনিতেই ব্যবসার জন্য কাউকে টাকা দেওয়া। এক্ষেত্রে কথা হয় যে, লাভ হিসেবে প্রতিমাসে কিছু কিছু দিবে। এটাও সুদী চুক্তি এবং রিবা নাসিয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত।
১৬. জুয়েলারী দোকানে স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদের উপর লোন প্রদান করা হয়। তেমনিভাবে ব্রাক, আশা, গ্রামের মহাজন সুদের ভিত্তিতে লোকদেরকে লোন দিয়ে থাকে। এগুলো সবই রিবা নাসিয়্যাহ।
১৭. ফরম বিক্রির ছুতায় রিবা নাসিয়্যাহ : কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সোসাইটি মানুষকে সুদবিহীন লোন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তাদের নিয়ম হল, ঋণের পরিমাণ অনুযায়ী ফরম কিনতে বাধ্য করা হয় আর ঋণের হার অনুযায়ী ফরমের দাম কম-বেশি হয়। যেমন, দশ হাজার টাকা ঋণের জন্য পাঁচশত টাকার ফরম ক্রয় করতে হয়। আর বিশ হাজার টাকার জন্য এক হাজার টাকার ফরম ক্রয় করতে হয় । আর নির্ধারিত মেয়াদের ভেতর তা পরিশোধ না করলে পরে আবারও আরেকটি ফরম ক্রয় করে পূরণ করতে হয়। বাহ্যিকভাবে এটি ফরম ক্রয়-বিক্রয়। কিন্তু এর মাধ্যমেই সুদ অগ্রীম আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। এজন্যই ঋণের পরিমাণ বাড়লে ফরমের মূল্যও বাড়তে থাকে। এটা হচ্ছে রিবা নাসিয়্যাহ গ্রহণের হীলা-বাহানা ও ছুতা অবলম্বন।
১৮. কিস্তি-বিক্রি : বাজারে ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী কিস্তিতে বিক্রি হয়। এই বিক্রির চুক্তিপত্রের মধ্যেই উল্লেখ থাকে সময়মত পরিশোধ করতে না পারলে একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ বাড়বে। এটা রিবাদ দাইন ও রিবা নাসিয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত। তাই এ ধরনের শর্ত সম্পূর্ণ নাজায়েয। আর বাধ্য হয়ে কেউ এধরনের শর্তে ক্রয় করলে নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরই কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। নতুবা সুদ দেওয়ার গুনাহ হবে। অতএব এ ধরনের ক্ষেত্রে সুদ থেকে বাঁচতে চাইলে যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করে দিতে হবে।
১৯. ইনস্টাবাই : Instabuy বিভিন্ন কোম্পানী ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারকে বিনা সুদে এবং অতিরিক্ত মূল্য ছাড়া ২/৩ বা ১২ কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের সুবিধা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ না করলে অতিরিক্ত সুদ দিতে হয়। এতে কারবারটি সুদী কারবারে পরিণত হয়ে যায়। তাই ইনস্টাবাই-এর সুবিধা গ্রহণ করলেও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় কারবার সুদী হয়ে যাবে। অর্থাৎ রিবাদ দাইনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
২০. নগদ, রকেট ও বিকাশ এর পক্ষ থেকে ইন্টারেস্ট
ক. নগদ, রকেট ও বিকাশ এর পক্ষ থেকে ইন্টারেস্ট হিসাবে যে টাকা পার্সোনাল ওয়ালেট/এজেন্ট ওয়ালেটে যোগ হয়,সেটা সুদ।আর সুদ খাওয়া হারাম।
খ. বিকাশের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো যে, ১০০ টাকা বিকাশ অ্যাপ থেকে রিচার্জ করলে ২০ টাকা ক্যাশব্যাক/ফেরত দেওয়া হবে।এই ক্যাশব্যাক সুদ।
কারণ বিকাশ কোম্পানিতে ওয়ালেট/অ্যাকাউন্ট ওপেন করার মধ্য দিয়ে বিকাশ কোম্পানি ইসলামি শরিয়াহ এর দৃষ্টিতে “মুস্তাকরিজ” বা ঋণগ্রহীতা হয়।আর “মুস্তাকরিজ” থেকে শর্তের ভিত্তিতে কিংবা প্রচলনের (উরফ) ভিত্তিতে কোনো ধরনের প্রফিট কনজিউম/ভোগ করলে সেটা সুদ হয়। এজন্য এধরনের ক্যাশব্যাক ভোগ করা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।কারণ সুদ ইসলামে হারাম।
গ. পণ্য ক্রয় করে বিকাশের মাধ্যমে বিল পেমেন্ট করলে যে ক্যাশব্যাক দেওয়া হয় সেটা সুদ।কারণ এই ক্যাশব্যাক পণ্য বিক্রেতা দেয় না।বরং বিকাশ কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।আর উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে,বিকাশ কোম্পানিতে ওয়ালেট/অ্যাকাউন্ট ওপেন করার মধ্য দিয়ে বিকাশ কোম্পানি ইসলামি শরিয়াহ এর দৃষ্টিতে “মুস্তাকরিজ” বা ঋণগ্রহীতা হয়।আর “মুস্তাকরিজ” থেকে শর্তের ভিত্তিতে কিংবা প্রচলনের (উরফ) ভিত্তিতে কোনো ধরনের প্রফিট কনজিউম/ভোগ করলে সেটা সুদ হয়।এজন্য পণ্য ক্রয় করে বিকাশের মাধ্যমে বিল পেমেন্ট করার কারণে যে ক্যাশব্যাক অর্জিত হয়, সেটা সুদ।
ঘ. ক্যাশব্যাক সুদের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য এটা ভোগ করা যাবে না।
মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৮/২৪৪-২৪৫, শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৩/১৪৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৪৮২, বাদায়েউস সানায়ে৫/২১২, শরহুল মাজাল্লা, খালেদ আতাসী ৩/১৯৬-১৯৭, ইলাউস সুনান ১৮/৬৪, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,হাদীস: ২১০৭৮ ১৩/৬৪৮,আন্নুতাফ ফিল ফাতাওয়া২৯৬, বাদায়েউস সানায়ে৬/৫১৮, ফাতাওয়ায়ে খানিয়া ৩/৫৯৬, ফাতাওয়ায়ে বাযযাযিয়া ৬/৭৪, রদ্দুল মুহতার ৬/৫২৩, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ৩৭৮৩, ফাতহুল কাদীর ৬/৮০-৮১