রোজা রাখার নিয়ম যেভাবে চালু হয়
আমরা বর্তমানে মাহে রমজানুল মোবারকের মূল্যবান সময় অতিবাহিত করছি। রমজান হলো- সেই মহামান্য অতিথি— যার কাছে রয়েছে আমাদের দেওয়ার মতো অনেক কিছু। যার মধ্যে নাজিল হয়েছিল মহাগ্রন্থ আল কোরআনুল কারিম। যাতে বৃদ্ধি পায় বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া। যাতে রয়েছে সবার জন্য জান্নাতে প্রবেশ করা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সুমহান সুযোগ।
রমজান এমন মাস— যে মাস আমাদের কাছে প্রতি বছর রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহান বাণী নিয়ে উপস্থিত হয়। যাতে ভালো কাজের প্রতিদান অসংখ্য হারে বৃদ্ধি পায়। পাপীষ্ট দুষ্ট শয়তানকে পেছনে থাকার ফরমান জারি করা হয়। যাতে রয়েছে সারাজীবনের পাপ মোচন করে আত্মা ও অন্তর পবিত্র করার অকল্পনীয় সহজ সহজ উপায়।
মাহে রমজানুল মোবারক সারা বিশ্বের মুসলমানের জন্য ধৈর্য্য, সহনশীলতা, সহানুভুতি ও জিকির-আজকার, তাসবিহ, তাহলিল, তেলাওয়াতে কোরআন, নফল ইবাদত, দান-সদকা ইত্যাদি প্রত্যেক রকমের ইবাদত-বন্দেগি করার আন্তর্জাতিক মৌসুম।
এই মাসের সবচেয়ে বড় ইবাদত হলো সিয়াম সাধনা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেরূপ সিয়াম ফরয করা হয়েছিল, তোমাদের ওপরও তদ্রুপ ফরজ করা হল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
হাদিসের ভাষায় রমজানুল মোবারকের মত একটি মাস পেয়েও যে ব্যক্তি নিজের পাপ-পঙ্কিলতার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারেনি, সে মস্ত বড় দুর্ভাগা। আর যে ব্যক্তি এই মাসের কল্যাণ-বরকত থেকে বঞ্চিত হয়, সে বাস্তবে হতভাগা ও বঞ্চিত ব্যক্তি।
এ মাসের ইবাদতের জন্য রাসুল (সা.) এক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সিয়ামব্রত পালন, তারাবির নামাজ আদায়, ইতিকাফ, কোরআন তেলাওয়াত, সদকা-খায়রাত ইত্যাদিসহ আরও অনেক ইবাদত এই মাসে করতেন।
সংজ্ঞা ও পরিচয়
‘সিয়াম’ বা ‘সাউম’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো- বিরত থাকা। তা যেকোনো কাজ থেকে হতে পারে। যথা- খাওয়া, পান করা, কথা বলা ও চলা ইত্যাদি।
শরিয়তের পরিভাষায় ‘সিয়াম’ বা ‘সাউম’ কিংবা [আমাদের দেশের প্রসিদ্ধ ভাষা মতে] ‘রোজা’ বলা হয়, ‘আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ফজরের সময়ের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী-সহবাস ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা।
ঐতিহাসিক পটভূমি
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিয়ামব্রত পালনের প্রথা প্রায় সকল ধর্মে এবং সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। কোরআন মজিদ এদিকে ইঙ্গিত করে বলেছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেরূপ সিয়াম ফরয করা হয়েছিল, তোমাদের উপরও তদ্রুপ ফরয করা হল, যাতে তোমরা তাক্কওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পার।’
‘গণনার কয়েকটি দিনের জন্য। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তাকে অন্য সময়ে সে সিয়াম পুরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়।’
‘রমজান হলো- সেই মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। অতএব তোমাদের থেকে যে এই মাস পাবে, সে এ মাসে সিয়াম পালন করবে। আর যে অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না- যাতে তোমরা গণনা পুরণ কর এবং তোমাদের হিদায়াত দান করার দরুন আল্লাহ তাআলার মহত্ব বর্ণনা করো, আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫)
এখানে স্পষ্টতঃ বলা হয়েছে যে, সিয়াম শুধু মুসলিম উম্মাহর উপর নয়, বরং আগের সব উম্মতের ওপরও ফরজ ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পৃথিবীতে এমন কোনো সম্প্রদায় ছিল না, যাদের ওপর আল্লাহ তাআলা সিয়াম ফরজ করেননি।
ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনের ‘সিয়াম’ বিষয়ক প্রবন্ধকার তার প্রবন্ধে বলেন, ‘আবহাওয়া, জাতিয়তা, সংস্কৃতি ও পরিবেশের ভিন্নতার কারণে যদিও সিয়ামের মৌলনীতি ও পদ্ধতি ভিন্ন ছিল। কিন্তু আমরা এমন কোনো মাজহাব কিংবা ধর্মনীতি দেখিনা যাতে সিয়ামব্রত পালনকে ধর্মের মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি।’
হিন্দুস্তানেও উপবাস যাপনের নিয়ম প্রচলিত ছিল। প্রত্যেক হিন্দি মাসের এগার ও বার তারিখে ব্রত পালন তথা একাদশী রোজা রাখা ব্রাহ্মণদের উপর জরুরি ছিল। এই হিসেবে বছরে চব্বিশটি রোজা হয়। কোনো কোনো ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসের প্রত্যেক সোমবারে উপবাস পালন করত। হিন্দু ধর্মজাযকরা কখনো চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার ছেড়ে দিত। (ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা : ১০/১৯৩)
ইহুদিদের মধ্যেও সিয়াম পালন আল্লাহর আবশ্যকীয় বিধান ছিল। মুসা (আ.) তূর পাহাড়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত সিয়াম পালন করেছিলেন। (খুরোজ : ৩৪, ৩৮)
তাই ইহুদিরাও তার অনুসরণে চল্লিশ দিন সিয়াম পালন করা ভাল মনে করত। কিন্তু চল্লিশতম সিয়াম তাদের জন্য ফরজ ছিল। যা তাদের সপ্তম মাসের দশম তারিখে পড়ে। এই কারণেই তাকে আশুরা বলা হয়। এটি ছিল সেই দিন যাতে মুসা (আ.) তাওরাত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। এ কারণে তাওরাতে এই দিনে সিয়ামের বিশেষ তাকিদ এসেছে। (তাওরাত, সিফরুল আহবার: ১৬, ১৯, ৩৪)
খ্রিস্টধর্মেও সিয়ামের প্রথা চালু ছিল। ঈসা (আ.) চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে সিয়াম পালন করেছেন। (আওয়াল সামুয়েল : ৬-৭; ইয়ারমিয়া; ৩৬/৬)
ইয়াহয়া (আ.) ও সিয়াম পালন করতেন এবং তার উম্মতও সিয়াম পালন করত। (মারক্বাস: ২৪)
ইসলামের পূর্বে আরবদের মধ্যেও কোনো না কোনোভাবে সিয়ামের প্রথা চালু ছিল। কুরাইশরা আশুরা তথা মুহাররামের দশ তারিখ সিয়াম পালন করত। মদিনা শরিফে ইহুদিরাও সপ্তম মাসের দশ তারিখে সিয়াম পালন করত। (মুসনাদু আহমদ: ৬/২৪৪; বুখারি : ১/৫৬২; সিরাতুন্নবী, আল্লামা সৈয়দ সুলায়মান নদভী, পৃষ্ঠা : ১৫০)