মসজিদুল আকসার পাশে যে স্থানে জন্ম নেন ঈসা আ.
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন ইঞ্জিন কিতাব দিয়ে। তার জন্মকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীবাসীর জন্য বানিয়েছেন একটি নিদর্শন। তাকে নিজ কুদরতে বাবা ছাড়া শুধু মায়ের গর্ভে জন্ম দিয়েছিলেন। হজরত জিবরাইলের মাধ্যমে মারইয়াম আলাইহাস সালামকে আল্লাহ তায়ালা একজন পবিত্র পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেন।
হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম চিরকুমারী পূতঃপবিত্র মারইয়াম আলাইহাস সালামের কাছে এসে বললেন, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন দূত। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে একজন পুত্র সন্তান দান করতে চান। যিনি ভবিষ্যতে নবী হবেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবেন এবং কোলে থাকতেই কথা বলবেন।
এ কথা শুনে তিনি বললেন, আমার সন্তান কীভাবে হতে পারে, আমার তো বিয়েই হয়নি। কখনো কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি, আমি ব্যভিচারিণীও নই।
উত্তরে জিবরাইল আলাইহিস সালাম মারইয়াম আলাইহাস সালামকে বললেন, এটা সত্য যে, স্বামী ছাড়া নারীর সন্তান হয় না, তবে আল্লাহ তায়ালা চাইলে সন্তান জন্মের কোনো উপকরণ ছাড়াও সন্তান জন্ম হওয়া সম্ভব। তিনি এই ঘটনাকে মানুষের জন্য নিদর্শন বানাতে চান। যেমন তিনি আদম আলাইহিস সালামকে মা-বাবা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন।
হজরত মারইয়াম আলাইহাস সালাম আল্লাহর নির্দেশের কথা শুনে তা মেনে নিলেন। তখন হজরত জিবরাইল মারইয়াম আলাইহিস সালাম তার জামার কলারের মধ্যে ফুঁ দিলেন, এরপর মারইয়াম মারইয়াম আলাইহাস সালাম আল্লাহর হুকুমে গর্ভবতী হয়ে গেলেন।
ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক রহিমাহুল্লাহ বলেন, মারইয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভের বিষয়টি যখন লোকজন জানতে পারল, তারা তাকে নিয়ে কটু কথা শুরু করলো এবং তাকে বিভিন্ন অপবাদ দিতে শুরু করল।
মানুষজনের কটুকথা আর আপবাদের মুখে হজরত মারইয়াম আলাইহাস সালাম লোকালয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন এবং নির্জন স্থানে চলে গেলেন, যেখানে তাকে কেউ দেখতে পাবে না এবং তিনিও কাউকে দেখতে পাবেন না। লোকালয় থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর তার প্রসব বেদনা উঠলো। তখন তিনি একটি খেজুর গাছের নিচে বসে পড়েন।
কথিত আছে, এই নির্জন স্থানটি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ব দিকের কক্ষটি। আরেক বর্ণনামতে, লোকালয় থেকে বের হয়ে তিনি যখন সিরিয়া ও মিসরের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছেন তখন তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায়, লোকালয় থেকে বের হয়ে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আট মাইল দূরে গিয়েছিলেন। যেখানে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয় সেই জায়গাটির নাম ছিলো বাইতে লাহাম। তাফসির গ্রন্থ ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, বায়তুল মুকাদ্দাসের আশপাশে কোথাও জন্মগ্রহণ করেছিলেন হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
হজরত মারইয়াম আলাইহাস সালামের প্রসব বেদনার ওঠার পর তিনি নিজের মৃত্যু কামনা করতে লাগলেন। একে তো প্রসব বেদনা, এর বাইরে তার মনে তখন ধারণা জন্মেছিলো যে, তার কোলে সন্তান দেখার পর কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চাইবে না, তার কথাকে মনগড়া মনে করবে। তার নামে বদনাম রটাবে। এসময় প্রসব ব্যথার থেকেও মৃত্যুকে তার কাছে বেশি সহজ মনে হলো। তিনি বললেন, হায় আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে পারতাম।
আরও পড়ুন
হজরত মারইয়াম আলাইহাস সালাম যখন সন্তান নিয়ে লোকালয়ে ফিরলেন, তাকে মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো। পবিত্র কোরআনের সূরা মারইয়ামের ১৬ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পুরো ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন এভাবে-
وَاذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ مَرۡیَمَ ۘ اِذِ انۡتَبَذَتۡ مِنۡ اَہۡلِہَا مَکَانًا شَرۡقِیًّا ۙ ١٦ فَاتَّخَذَتۡ مِنۡ دُوۡنِہِمۡ حِجَابًا ۪۟ فَاَرۡسَلۡنَاۤ اِلَیۡہَا رُوۡحَنَا فَتَمَثَّلَ لَہَا بَشَرًا سَوِیًّا ١٧ قَالَتۡ اِنِّیۡۤ اَعُوۡذُ بِالرَّحۡمٰنِ مِنۡکَ اِنۡ کُنۡتَ تَقِیًّا ١٨ قَالَ اِنَّمَاۤ اَنَا رَسُوۡلُ رَبِّکِ ٭ۖ لِاَہَبَ لَکِ غُلٰمًا زَکِیًّا ١٩ قَالَتۡ اَنّٰی یَکُوۡنُ لِیۡ غُلٰمٌ وَّلَمۡ یَمۡسَسۡنِیۡ بَشَرٌ وَّلَمۡ اَکُ بَغِیًّا ٢۰ قَالَ کَذٰلِکِ ۚ قَالَ رَبُّکِ ہُوَ عَلَیَّ ہَیِّنٌ ۚ وَلِنَجۡعَلَہٗۤ اٰیَۃً لِّلنَّاسِ وَرَحۡمَۃً مِّنَّا ۚ وَکَانَ اَمۡرًا مَّقۡضِیًّا ٢١ فَحَمَلَتۡہُ فَانۡتَبَذَتۡ بِہٖ مَکَانًا قَصِیًّا ٢٢ فَاَجَآءَہَا الۡمَخَاضُ اِلٰی جِذۡعِ النَّخۡلَۃِ ۚ قَالَتۡ یٰلَیۡتَنِیۡ مِتُّ قَبۡلَ ہٰذَا وَکُنۡتُ نَسۡیًا مَّنۡسِیًّا ٢٣ فَنَادٰىہَا مِنۡ تَحۡتِہَاۤ اَلَّا تَحۡزَنِیۡ قَدۡ جَعَلَ رَبُّکِ تَحۡتَکِ سَرِیًّا ٢٤ وَہُزِّیۡۤ اِلَیۡکِ بِجِذۡعِ النَّخۡلَۃِ تُسٰقِطۡ عَلَیۡکِ رُطَبًا جَنِیًّا ۫ ٢٥ فَکُلِیۡ وَاشۡرَبِیۡ وَقَرِّیۡ عَیۡنًا ۚ فَاِمَّا تَرَیِنَّ مِنَ الۡبَشَرِ اَحَدًا ۙ فَقُوۡلِیۡۤ اِنِّیۡ نَذَرۡتُ لِلرَّحۡمٰنِ صَوۡمًا فَلَنۡ اُکَلِّمَ الۡیَوۡمَ اِنۡسِیًّا ۚ ٢٦ فَاَتَتۡ بِہٖ قَوۡمَہَا تَحۡمِلُہٗ ؕ قَالُوۡا یٰمَرۡیَمُ لَقَدۡ جِئۡتِ شَیۡئًا فَرِیًّا ٢٧ یٰۤاُخۡتَ ہٰرُوۡنَ مَا کَانَ اَبُوۡکِ امۡرَاَ سَوۡءٍ وَّمَا کَانَتۡ اُمُّکِ بَغِیًّا ۖۚ ٢٨ فَاَشَارَتۡ اِلَیۡہِ ؕ قَالُوۡا کَیۡفَ نُکَلِّمُ مَنۡ کَانَ فِی الۡمَہۡدِ صَبِیًّا ٢٩ قَالَ اِنِّیۡ عَبۡدُ اللّٰہِ ۟ؕ اٰتٰنِیَ الۡکِتٰبَ وَجَعَلَنِیۡ نَبِیًّا ۙ ٣۰ وَّجَعَلَنِیۡ مُبٰرَکًا اَیۡنَ مَا کُنۡتُ ۪ وَاَوۡصٰنِیۡ بِالصَّلٰوۃِ وَالزَّکٰوۃِ مَا دُمۡتُ حَیًّا ۪ۖ ٣١ وَّبَرًّۢا بِوَالِدَتِیۡ ۫ وَلَمۡ یَجۡعَلۡنِیۡ جَبَّارًا شَقِیًّا ٣٢ وَالسَّلٰمُ عَلَیَّ یَوۡمَ وُلِدۡتُّ وَیَوۡمَ اَمُوۡتُ وَیَوۡمَ اُبۡعَثُ حَیًّا ٣٣ ذٰلِکَ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ ۚ قَوۡلَ الۡحَقِّ الَّذِیۡ فِیۡہِ یَمۡتَرُوۡنَ ٣٤
আর স্মরণ করুন। এ কিতাবে মারইয়ামকে, যখন সে তার পরিবারের কাছ থেকে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্ব দিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল, তারপর সে তাদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করল। তখন আমি তার কাছে আমার রূহকে (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম) পাঠালাম, সে তার কাছে পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্ৰকাশ করল।
মারইয়াম বলল, আমি তোমার থেকে দয়াময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করছি (আল্লাহকে ভয় কর) যদি তুমি মুত্তাকী হও। সে বলল, আমি তো তোমার রব-এর দূত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য (আমি প্রেরিত হয়েছি)। মারইয়াম বলল, কেমন করে আমার পুত্র হবে, যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই!
সে বলল, ‘এই ভাবেই হবে; তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং তাকে আমি এই জন্য সৃষ্টি করব, যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে এক অনুগ্রহ; এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।’
এরপর সে গর্ভে সন্তান ধারণ করল ও তাকে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। প্রসব-বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বলল, হায়, এর আগে যদি আমি মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতাম!
তখন ফেরেশতা (জিবরাঈল) তার নিচ থেকে ডেকে তাকে বলল, তুমি পেরেশান হয়ো না,তোমার রব তোমার নিচে একটি ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন। আর তুমি খেজুর গাছের কান্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, তাহলে তা তোমার উপর তাজা-পাকা খেজুর ফেলবে। তুমি খাও, পান কর এবং চোখ জুড়াও। আর যদি তুমি কোন লোককে দেখতে পাও তাহলে বলে দিও, ‘আমি পরম করুণাময়ের জন্য চুপ থাকার মানত করেছি। অতএব আজ আমি কোন মানুষের সাথে কিছুতেই কথা বলব না’।
তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল; তারা বলল, হে মারইয়াম! তুমি তো এক অঘটন করে বসেছ। হে হারূনের বোন! তোমার বাবা অসৎ ব্যক্তি ছিল না এবং তোমার মা'ও ছিল না ব্যভিচারিণী।
মারইয়াম তখন ইঙ্গিতে সন্তানকে দেখাল। তারা বলল, যে দোলনার শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?’ (শিশুটি) বলল, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামাজ ও জাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি দাম্ভিক, হতভাগ্য। আমার প্রতি শান্তি, যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি ও যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হব।
এই হচ্ছে মারইয়াম পুত্র ঈসা। এটাই সঠিক বক্তব্য, যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করছে। (সূরা মারইয়াম, (১৯), আয়াত, ১৬-৩৪, তাফসিরে ইবনে কাসির, ১৪-খণ্ড, ১৪৬)