আল্লাহর আদেশ অমান্য করায় বনী ইসরাঈল যে শাস্তি পেয়েছিল
বনি ইসরায়েলের প্রধান পুরুষ ছিলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। তার বাসস্থান ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বা ফিলিস্তিনের জেরুসালেম অঞ্চলে। তবে তার ছেলে ইউসুফ আলাইহিস সালাম মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর তারা সবাই মিসরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
মুসা আ.-এর পবিত্র ভূমিতে ফেরার ইচ্ছা
এখানেই আবির্ভাব ঘটে আরেক নবী হজরত মূসা আলাইহিস সালামের। মুসা আলাইহিস সালামের জাতির ওপর দীর্ঘদিন অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছিলো ফেরাউন। ফেরাউনের কবল থেকে বনি ইসরায়েলের মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা মুসা আলাইহিস সালামকে তার জাতিকে নিয়ে মিসরে ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এই সময় মূসা আলাইহিস সালাম তার পূর্বপুরুষের ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পাওয়ার পর মূসা আলাইহিস সালাম তার জাতিকে বলেন,
یٰقَوۡمِ ادۡخُلُوا الۡاَرۡضَ الۡمُقَدَّسَۃَ الَّتِیۡ کَتَبَ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَرۡتَدُّوۡا عَلٰۤی اَدۡبَارِکُمۡ فَتَنۡقَلِبُوۡا خٰسِرِیۡنَ یقوم ادخلوا الارض المقدسۃ التی کتب الله لکم و لا ترتدوا علی ادبارکم فتنقلبوا خسرین
‘হে আমার কওম, তোমরা পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন এবং তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যেয়ো না, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে’। (সূরা মায়েদা, (৫), আয়াত, ২১)
পবিত্র ভূমি কোনটি
কোরআনের এই আয়াতে পবিত্র ভূমি বলতে কোন ভূমি বোঝানো হয়েছে, এ প্রশ্নে তাফসীরবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। কারো মতে বায়তুল-মুকাদ্দাস, কারো মতে কুদস শহর ও ইলিয়া এবং কেউ কেউ বলেন, আরিহা শহর- যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যস্থলে বিশ্বের একটি প্রাচীনতম শহর যা পূর্বেও ছিল এবং এখনও আছে।
আরও পড়ুন
কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে যে, পবিত্র ভূমি বলে দামেস্ক ও ফিলিস্তিনকে এবং কারো মতে জর্দানকে বোঝানো হয়েছে। কাতাদাহ বলেন, সমগ্র শামই পবিত্র ভূমি। (ইবনে কাসীর, আত-তাফসীরুস সহীহ)
আমালেকা সম্প্রদায়
বিভিন্ন তাফসিরে এসেছে, মুসা আলাইহিস সালাম বনি ইসরায়েলকে নিয়ে পবিত্র ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসে আগমনকালে সিরিয়া ও বায়তুল মুকাদ্দাস আমালেকা নামক এক সম্প্রদায়ের দখলে ছিল। সেখানে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা ছিল আদ সম্প্রদায়ের একটি শাখা। দৈহিক দিক দিয়ে তারা অত্যন্ত সুঠাম, বলিষ্ঠ ও ভয়াবহ আকৃতিবিশিষ্ট ছিল।
বনি ইসরায়েলকে যুদ্ধ ও বিজয়ের সুসংবাদ
এই ভূমিতে বনি ইসরায়েলের বসবাসের জন্য আমালেকা সম্প্রদায়কে এখান থেকে সরানো জরুরি ছিল। এজন্য আল্লাহ তায়ালা তাদের সঙ্গে জিহাদ করে বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করার নির্দেশ দেন মূসা আলাইহিস সালাম ও বনি ইসরায়েলকে।
যুদ্ধের নির্দেশের পাশাপাশি তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা এ সুসংবাদও দিয়ে দেন যে, এ পবিত্র ভূখণ্ড তাদের জন্য লেখা হয়ে গেছে। কাজেই তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। তারা আমালেকা গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করলেই এ ভূমি ফিরে পাবে।
বনি ইসরায়েলের বদ স্বভাব
কিন্তু বনি ইসরায়েলের স্বভাবে সবসময় ঔদ্ধত্য ও বক্রতা ছিল। তারা আল্লাহর আদেশ পালন করতে রাজি হলো না। যুদ্ধে বিজয়ের সুসংবাদ পাওয়ার পরও তারা আমালেকা সম্প্রদায়ের প্রচলিত বীরত্ব-প্রসিদ্ধির কারণে ভীতু হয়ে পড়ে, প্রথম ধাপেই শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলে । এবং যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
তারা মূসা আলাইহিস সালামকে বলল, হে মূসা! এ দেশে প্রবল পরাক্রান্ত জাতি বাস করে। যতদিন এ দেশ তাদের দখলে থাকবে, ততদিন আমরা সেখানে প্রবেশ করব না। যদি তারা অন্য কোথাও চলে যায়, তবে আমরা সেখানে যেতে পারি।
বনি ইসরায়েল সাহসও করলো না!
পুরো বনি ইসরায়েলে শুধু দুইজন ব্যক্তি ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার ছিলেন, আল্লাহর শক্তি ও সাহায্যের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাদের অন্তরে। তারা মূসা আলাইহিস সালামের আদেশ মানতে রাজি হলেন। এর পাশাপাশি তারা নিজ সম্প্রদায়কে বোঝাতে লাগলেন যে, তোমরা সাহস তো কর। তারপর দেখ, কেমন করে আল্লাহ তোমাদেরকে (ওই শত্রুদের ওপর) বিজয় দান করেন।
তারা নিজের নবীর মুখে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয়ের সুসংবাদ শুনেও তা অস্বীকার করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে নিজ সম্প্রদায়ের লোকের উপদেশ তাদের কাছে কোনো গুরুত্ববহন করেনি।
বনি ইসলায়েলের কাপুরুষতা
এ সময় তারা কাপুরুষতা, বেআদবী, অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের চরমে চলে গেল। বিদ্রূপের ভঙ্গিতে মূসা আলাইহিস সালামকে বলল যে, ‘তুমি ও তোমার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসলাম!’
তাদের এই বিদ্রুপ ও অবাধ্যতার কথা আল্লাহ তায়ালা সরাসরি কোরআনে তুলে ধরেছেন। বর্ণিত হয়েছে,
قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّ فِیۡهَا قَوۡمًا جَبَّارِیۡنَ ٭ۖ وَ اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَهَا حَتّٰی یَخۡرُجُوۡا مِنۡهَا ۚ فَاِنۡ یَّخۡرُجُوۡا مِنۡهَا فَاِنَّا دٰخِلُوۡنَ قَالَ رَجُلٰنِ مِنَ الَّذِیۡنَ یَخَافُوۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمَا ادۡخُلُوۡا عَلَیۡهِمُ الۡبَابَ ۚ فَاِذَا دَخَلۡتُمُوۡهُ فَاِنَّکُمۡ غٰلِبُوۡنَ ۬ۚ وَ عَلَی اللّٰهِ فَتَوَکَّلُوۡۤا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَهَاۤ اَبَدًا مَّا دَامُوۡا فِیۡهَا فَاذۡهَبۡ اَنۡتَ وَ رَبُّکَ فَقَاتِلَاۤ اِنَّا هٰهُنَا قٰعِدُوۡنَ
অর্থাৎ, তারা বলল, ‘হে মূসা, নিশ্চয় সেখানে রয়েছে এক শক্তিশালী জাতি এবং আমরা নিশ্চয় সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না তারা সেখান থেকে বের হয়। অতঃপর যদি তারা সেখান থেকে বের হয়, তবে নিশ্চয় আমরা প্রবেশ করব’।
যারা (আল্লাহকে) ভয় করছিল তাদের মধ্যে দু’জন লোক যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন বলল, তাদের দরজায় হানা দাও, ঢুকলেই তোমরা জয়ী হয়ে যাবে। তোমরা মু’মিন হলে আল্লাহর উপর ভরসা কর।
তারা বলল,
(সূরা মায়েদা, (৫), আয়াত, ২২-২৪)
আল্লাহর কাছে মুসা আ.-এর বিশেষ আবেদন
মুসা আলাইহিস সালাম যখন নিজের সম্প্রদায়কে (ইহুদি জাতি/ বনি ইসরায়েল) কোনোভাবে বোঝাতে পারলেন না, তার নিজেদের অবাধ্যতা ও আল্লাহর নির্দেশ পালনে বিদ্রোহ থেকে কোনোভাবে ফিরে আসলো না, তখন তিনি নিজের অক্ষমতা ও দুর্বলতা প্রকাশ করলেন এবং তাদের সঙ্গে নিজের সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করলেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ لَاۤ اَمۡلِکُ اِلَّا نَفۡسِیۡ وَ اَخِیۡ فَافۡرُقۡ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَ الۡقَوۡمِ الۡفٰسِقِیۡنَ
সে (মুসা আলাইহিস সালাম) বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার আর আমার ভাইয়ের উপর ছাড়া কারো উপর আমার ক্ষমতা নেই, কাজেই এই বিদ্রোহী সম্প্রদায় থেকে আমাদেরকে পৃথক করে দিন।’ (সূরা মায়েদা, (৫), আয়াত, ২৫)
বনি ইসরায়েলকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া শাস্তি
মুসা আলাইহিস সালামের এমন অপারগতা প্রকাশের পর আল্লাহ তায়ালা এই অবাধ্য সম্প্রদায়কে শাস্তি দিলেন। শাস্তি হিসেবে তাদের সেই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করার অধিকার কেড়ে নিলেন। তারা যেখানে বসে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিলো সেই ভূমির নাম তীহ। নিজেদের বিদ্রোহ ও জিহাদ থেকে বিমুখতার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এই ভূমিতে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরিয়েছিলেন। তারা ৪০ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন এই ভূমি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতো কিন্তু ঘুরেফিরে দেখতো তারা আগের সেই জায়গাতেই রয়ে গেছে। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন।
এটা ছিল বনি ইসরায়েলের জন্য দুনিয়ার নির্ধারিত শাস্তি। হয়ত এর মাধ্যমে তাদের উপর আপতিত কোন কঠোর শাস্তি লাঘব করা হয়েছিল। আর শাস্তি হিসেবে চল্লিশ বছর নির্ধারনের কারণ সম্ভবত ছিল যে, এ সময়ের মধ্যে সে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের মৃত্যু সংঘটিত হবে, ফেরাউনের দাসত্ব ও তাবেদারীর কারণে সম্মানের সঙ্গে জীবযাপন করার মত সাহস তাদের ছিল না, তাই তারা সম্মুখ লড়াই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
তবে হতে পারে ৪০ বছরে এই লোকজন মরে যাওয়ার পর যারা জন্ম গ্রহণ করবে তারা শত্রুদের পরাভূত করার মত সাহসী হতে পারবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
এনটি