মসজিদুল আকসা সম্পর্কে রাসূল সা.-এর কাছে কুরায়শরা যা জানতে চেয়েছিল
ইসলামের সূচনাকাল বিশেষত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। পুরো একটা সমাজ, পরিবেশ যেই ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিলো তার বিপরীতে গিয়ে এক আল্লাহর ওপর ঈমানের কথা বলায় সবার রোষানলে পড়েন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একত্বাবাদের প্রায় প্রতিটি বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তুলতো মক্কার কাফেররা।
অদৃশ্য রবে কুরায়শদের অবিশ্বাস
নিজ হাতে তৈরি, নিজের সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা দেব-দেবীর পূজা-আর্চনায় লিপ্ত জনগোষ্ঠীর কাছে অদৃশ্য রবের ইবাদত কোনোভাবেই বোধগম্য ছিলো না।
ইসলামের পথে আহ্বানের আগ পর্যন্ত কুরায়শরা একবাক্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা মেনে নিতো। কিন্তু তিনি যখন এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের আহ্বান জানালেন তখন তারা তা মানতে পারছিলো না কোনোভাবে।
রাসূলের প্রতি কুরায়শদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস!
মক্কাবাসীকে প্রকাশ্যে ইসলাম সম্পর্কে জানানোর আগে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সবাইকে একত্রিত করে বলেছিলেন, আমি যদি বলি এই পাহাড়ের পেছনে এক দুর্ধর্ষ শত্রু বাহিনী ওতপেতে আছে সুযোগ পেলেই তারা তোমাদের ওপর হামলা করবে তোমরা কি আমfর কথা বিশ্বাস করবে?
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই প্রশ্নের জবাবে কুরায়শেরা সমস্বরে বলে উঠেছিলো- অবশ্যই আপনার কথা মেনে নেবো, কারণ, আপনি আল-আমিন, কখনো মিথ্যা বলেননি। ঠিক এই মুহূর্তে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এক রবের ওপর ঈমান আনার বিষয়ে আহ্বান করেন।
একটু আগেও যারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা একবাক্যে বিশ্বাস করে নিয়েছিলো তাওহিদের বাণী শুনে তারা তৎক্ষণাৎ অস্বীকার করে বসে, আবু লাহাব বলে উঠে, মুহাম্মদ! ধ্বংস হোক তোমার! তুমি কি এমন কথা শোনানোর জন্য আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিলে!
মক্কার কঠিন পরিস্থিতি
এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও একত্ববাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার তাওহিদের আহ্বানে যেনো মানুষ সাড়া দিতে না পারে, এজন্য প্রতিদিন মক্কার পরিবেশ কঠিন থেকে কঠিনতর করে রাখতো কাফেরেরা। কাফেরদের নির্যাতন, রক্তচক্ষুর সামনে নবীজির মানসিক শক্তি ছিলেন আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। কুরায়শদের সামনে নবীজির পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেলেন ছিলেন আবু তালেব। এই দুইজনের ইন্তেকালের পর কুরায়েশেরা নবীজিকে মানসিকভাবে পীড়া দিতে থাকে।
নবীজিকে আল্লাহর শান্ত্বনা
এই মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা তার হাবীবকে শান্ত্বনা হিসেবে মেরাজের ঘটনা উপহার দেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে এক রাতেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কা থেকে ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস, সাত আসমান, জান্নাত-জাহান্নাম ভ্রমণ করিয়েছিলেন। একে কোরেআনের ভাষায় ইসরা বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ বলা হয়।
মক্কা থেকে ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসার দূরত্ব প্রায় দুই মাসের। এক রাতেই এই পরিমাণ দূরত্ব যাতায়াত করা, একই সঙ্গে সাত আসমান ভ্রমণের ঘটনা পৃথিবীর চোখে কাল্পনিক ও অবাস্তব মনে হয়, বিশ্বাস করাও বেশ কঠিন।
মেরাজের ঘটনায় কুরায়শদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মানুষের সামনে এই ভ্রমণের কথা বললেন, তখন স্বভাবতই তারা এটা অবিশ্বাস করলো। আবু জাহেল, আবু লাহাব, উতবা শায়বার মতো কুরায়শ নেতারা, রীতিমতো ঠাট্টা-বিদ্রুপ শুরু করে দিলো। অনেক মুসলিমও এ ঘটনা শুনে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।
মুশরিকেরা বললো- আমরা দ্রুতগতির বাহন ব্যবহার করেও এক মাসে মসজিদুল আকসায় পৌঁছাতে পারি না, আর তুমি একরাতে এসব ভ্রমণ করে ফেলেছো! তোমার কথা কে বিশ্বাস করবে, তোমার কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে আমাদেরকে বিশ্বাস করানোর মতো!
কুরায়শ কাফেলার স্বীকারোক্তি
নবীজি তখন বললেন, আমি বোরাকে ভ্রমণের সময় অমুক অমুক জায়গায় কুরায়শদের কাফেলা দেখেছি, তারা ফিরে এলে তোমরা তাদের জিগেস করতে পারো। কাফেলা ফিরে এলে তারা কুরায়শদের কাছে স্বীকার করলো যে, তারা সে সময় নবীজির বলা জায়গায় অবস্থান করছিলো, এবং তারা বোরাকের শব্দও শুনেছিলো।
আবু বকর রা.-এর স্বীকারোক্তি
কুরায়শ নেতারা এরপরও মেরাজের ঘটনা বিশ্বাস করছিলো না। তারা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে গিয়ে বললো- শুনেছো! মুহাম্মদ এসব কি বলছে! সে নাকি একরাতে এতো কিছু ভ্রমণ করে ফেলেছে!
একথা শুনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি নিজের থেকে একথা বলে থাকেন তাহলে আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার কথা বিশ্বাস করছি।
আরও পড়ুন
এরপরও কুরায়শরা মেরাজের ঘটনার ব্যাপারে আশস্ত হতে পারছিলো না। তখন তাদের কাছে এক ব্যক্তি ছিলো, যে মসজিদুল আকসার আকার-আকৃতি, দরজা-জানালা সবকিছু ঠিকঠাক চিনতো এবং এ সম্পর্কে তার ভালো জানাশোনা ছিল।
মসজিদুল আকসা সম্পর্কে নবীজির কাছে কুরায়শদের প্রশ্ন
কুরায়শরা মেরাজের ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে আরও একবার আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্নের মুখোমুখি করলো এবং তারা আল্লাহর রাসূলের কাছে জানতে চাইলো-
‘বায়তুল মুকাদ্দাস কোন দিকে অবস্থিত, কোন দিকের দেয়াল কেমন, জানালা কয়টা, দরজা কয়টা?’
তারা এ জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্ন করলো নবীজিকে। সাধারণত এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।
কারণ, আল্লাহর রাসূলের রাত্রীকালীন এই ভ্রমণ ছিলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের ভ্রমণ। তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস দেখতে বা এর দরজা জানালা গুনতে সেখানে যাননি।
তবে কুরায়শদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতার মাধ্যমে তার হাবীবের সামনে বায়তুল মুকাদ্দাসের চিত্র তুলে ধরলেন। তা দেখে দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মুকাদ্দাসের পুরো বিবরণ তুলে ধরলেন। রাসূলের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে মনে হয়েছিলো, যে তিনি সরাসরি বায়তুল মুকাদ্দাস দেখে উত্তর দিচ্ছিলেন।
উত্তর শুনে সেই ব্যক্তি বললেন, আপনি সত্য বলেছেন, বায়তুল মুকাদ্দাসের সঠিক বিবরণ তুলে ধরেছেন আপনি।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও এর আগে বায়তুল মুকাদ্দাস দেখেছিলেন, তখন তিনিও বলে উঠেলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি চরম সত্যবাদী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।
(তাফরিরে মাআরিফুল কোরআন, ৫ম-খণ্ড, ৪৩৩, তাফসিরে ইবনে কাসির, ১৩-খণ্ড, ২৬৭)