নবীজি (সা.)-এর চুল যেমন ছিল
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে আরব-পুরুষদের রীতি ছিল লম্বা চুল রাখা। রাসুল নিজেও লম্বা চুল রাখতেন। তার চুল কখনো কানের মাঝামাঝি, কানের লতি কিংবা দুই কাঁধ পর্যন্ত লম্বা থাকতো। তার চুল কাঁধ ছাড়িয়ে আরো লম্বা হত বলে জানা যায়। (তিরমিজি, আশ-শামাইল আল-মুহাম্মাদিয়া: ৪৭-৫০; আবু দাউদ; ৪/৮১; আলবানি, মুখতাসারুশ শামাইল: ৩৪-৩৬)
♦ কখনো এতদূর পর্যন্ত লম্বা হতো যে, তা বেণী বা গুচ্ছ করে রাখতেন। তার চাচাতো বোন উম্মে হানি (রা,) বলেন, ‘(মক্কা বিজয়ের সময়) আল্লাহর রাসুল যখন মক্কায় আগমন করলেন, তখন তার চুলে চারটি গুচ্ছ বা বেণী ছিল। (তিরমিজি, আস-সুনান ৪/২৪৬; আবু দাউদ, আস-সুনান : ৪/৮৩, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান : ২/১১৯৯; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৬/৫৭২, ১০/৩৬০; আলবানি, মুখাতাসারুশ শামাইল : ৩৫)
♦ আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তার চুল যখন লম্বা হতো তখন তিনি তা চারটি গুচ্ছে বিভক্ত রাখতেন।’ (যাদুল মা’আদ : ১/১৭০)
উল্লেখ্য যে, আরবিতে চুল জড়িয়ে বা বিনুনি করাকে "গাদীরাহ" বলে। হাদীসে "আরবায়ু গাদায়ের" চারটি গুচ্ছ ভাষাটি ব্যাবহার হয়েছে।
♦ ইবনু হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘অধিকাংশ সময়ে তার চুল এরূপ কাঁধের কাছাকাছি থাকত। কখনো তা আরো লম্বা হতো এবং ঝুলন্ত গুচ্ছে পরিণত হতো। তিনি সেগুলোকে বেণী বানিয়ে রাখতেন।’ তবে কাঁধ পর্যন্ত থাকা তার স্বাভাবিকতা ছিল। (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ১০/৩৬০)
♦ হজ বা ওমরাহ ব্যতীত তিনি কখনো মাথার চুল মুণ্ডন করেছেন— বলে জানা যায় না। (ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা’আদ : ১/১৬৭, শামি, সিরাহ শামিয়াহ : ৭/৩৪৯-৩৫০)
সেজন্যই এ নিয়ে মতভেদ আছে— মুণ্ডন করা যাবে কি যাবে না। কোনো কোনো ফকিহ হজ-ওমরাহ ছাড়া মাথা মুণ্ডনকে মাকরুহ বলেছেন। দুই কারণে তাদের মতের পক্ষে এ প্রমাণ পেশ করেন। প্রথমত, রাসুল (সা.) নিজে কখনোই হজ-ওমরাহ ছাড়া মাথা মুণ্ডন করেননি। দ্বিতীয়ত - বিভিন্ন হাদিস থেকে মাথা মুণ্ডন আপত্তিকর বলে জানা যায়। সাহাবিগণ ছোট চুল রাখতেন; নেড়া করা পরিহার করতেন।
♦ জাবির (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘হজ বা ওমরাহ ছাড়া মাথার চুল ফেলা যাবে না।’ (হাদিসটির সনদ দুর্বল; তাবারানি, আল মুজামুল আওসাত : ৯/১৮০)
*দূর্বল হলেও বেশ কয়েক সনদে হাদিসটি উল্লেখ আছে। (তবে হাদীসের বর্ননা সূত্রের কেউ মিথ্যায় অভিযুক্ত নন)। আবু নু'আইমের বর্ণনায় হাদিসটি হলো, হজ বা ওমরাহ ছাড়া মাথার চুল ফেলা যাবে না। এছাড়া তা সৃষ্টি-বিকৃতি করা বলে গণ্য হবে।’ (আবু নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া : ৮/১৩৯)
♦ জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (মাথার চুল) মুণ্ডন করে, (পোশাক-পরিচ্ছদ) ছিড়ে ফেলে বা চিৎকার করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (সহিহ সনদ) বুখারি, আস-সহিহ : ৬/২৭৪৮)
♦ আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে একাধিক গ্রহণযোগ্য সনদে এ অর্থে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (তবে এ হাদিসটি মূলত বিপদ-মসিবতে অধৈর্য্য হয়ে এরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে)
♦ দুবা'য়ি নামক এক নিকৃষ্ট অপরাধী ব্যক্তিকে হযরত উমার (রা) শাস্তি প্রদান করেন এবং বলেন, ‘তোমাকে যদি মাথা মুণ্ডিত অবস্থায় পেতাম, তবে আমি যাতে তোমার চক্ষুদ্বয় রয়েছে তা (তোমার মস্তক) তরবারির আঘাতে কেটে ফেলতাম।’ মানে শাস্তি অধিক হতো। (ইবনু কুদামা, আল-মুগনি : ১/৬৫)
এ থেকেও বোঝা যায়, সাহাবিগণ মাথা মুণ্ডনের অভ্যাসকে আপত্তিকর বলে মনে করতেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহ.) বলেন, প্রথম যুগের সালাফরা মাথা মুণ্ডন করা মাকরুহ বলে মনে করতেন। (মোল্লা আলী কারি, মিরকাত : ৮/২৪০) অবশ্য, তা হারাম বা গুনাহের কাজ ভাবা যাবেনা।
♦ মোল্লা আলী কারি (রহ.) বলেন, ‘চুল দীর্ঘ হওয়া কোনো নিন্দিত বিষয় নয়। কাঁধ ছাপিয়ে পরিমাপের চেয়ে বড় হলে চুল কেটে ফেলতে হবে বলেও কোনো নির্দেশ নেই।’ (মিরকাত : ৮/২৪০)
সুতরাং পুরুষের চুল কাঁধের নীচে চলে গেছে মানেই তিনি গুনাহ করছেন এটি দ্বীনি জ্ঞানে অজ্ঞদের ভাবনা। তবে এটি দারা অহংকার প্রকাশ যেনো না হয়।
♦ তবে মনে রাখতে হবে- বড় চুল রাখা পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। অনেক ফকিহ দাড়ি বড় হবার আগে চুল বড় করতে নিষেধ করেছেন (মেয়েদের সঙ্গে সাদৃশ্য হতে পারে বলে)। ছোট করে চুল রাখাও জায়েজ। তবে মাথার সব অংশে তা সমান হতে হবে। কোথাও বড়, আবার কোথাও ছোট— এভাবে কাটা ইসলামসম্মত নয়।
♦ কাতাদাহ (রা) থেকে বর্ণিত - তার কাধ ছাপিয়ে বিশাল চুল নিয়ে রাসসুল (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলে রাসুল (সা.) তাঁকে একদিন পর একদিন চুল আঁচড়াতে এবং পরিপাটি করে রাখতে নির্দেশ দেন। (নাসায়ি : ৮/১৮৪)
♦ চুলে তেল দেওয়া, সুগন্ধি মিশিয়ে তেল দেওয়া, পুরুষের জন্য আঁচড়িয়ে পরিপাটি রাখা, মাঝে সিঁথি করাও সুন্নাহ। (মুয়াত্তা মালিক : ২/৯৪৯)
♦ সুতরাং যাদের সম্ভব রাসুল (সা.)-এর চুলের এ দায়েমি সুন্নতের ওপর আমল করতে পারি। কেউ বড় চুল রাখলে, কানের লতি ছাপিয়ে নীচে গেলেই— না বুঝে আপত্তিকর বাজে মন্তব্য না করি। আল্লাহ আমাদের বুঝ দান করুন।
আরো বিস্তারিত জানতে ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) রচিত ‘ইসলামে পোশাক পর্দা ও দেহ-সজ্জা’ বইটি পড়ে নিতে পারেন।