মহামারি থেকে বাঁচতে মহানবীর নির্দেশনা
[যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক’ পত্রিকায় গত বছরের ১৭ মার্চ একটি দারুণ তথ্যনির্ভর আর্টিকেল প্রকাশ হয়েছিল। লিখেছিলেন টেক্সাসের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ক্রেইগ কান্সিডিন। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘Can the power of prayer stop a pandemic like the coronavirus? Even the Prophet Muhammad thought otherwise; যেটি তখন মুসলিম বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
ড. ক্রেগ ক্যানসিডাইন ‘Islam in America: Exploring the issue’-সহ পাঠকপ্রিয় বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তার চমৎকার সেই লেখাটি ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ।]
পাঠক, আপনি কি জানেন, মহামারির সময়ে কে সর্বোত্তম স্বাস্থ্যবিধি ও কোয়ারেন্টাইনের পরামর্শ দিয়েছে? ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)। ১৩০০ বছর আগে তিনি মহামারি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছেন। তিনি কোনো কঠিন রোগের পেশাদার চিকিৎসক নন। তবে কভিড-১৯-এর মতো রোগের বিস্তার রোধে মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশনা খুবই প্রাসঙ্গিক।
মেলামেশা ও জনবিচ্ছিন্নতার নির্দেশনা
উসামা বিন জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি কোনো অঞ্চলে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে তাতে প্রবেশ করবে না। তবে সেখানে থাকাবস্থায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তুমি সেখান থেকে বের হবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭২৮)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার সংক্রামক রোগ আছে, সে যেন সুস্থদের থেকে দূরে থাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৭১, মুসলিম, হাদিস : ৫৬৮৪)।
স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস ও পরিচ্ছন্নতা
মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতিকে স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস অনুসরণ করতে প্রবলভাবে উৎসাহ দেন, যেন সবাই সংক্রমণ রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। মুহাম্মদ (সা.)-এর নিম্নোক্ত হাদিসগুলো পড়ুন ও ভাবুন :
আবু মালেক আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন—
পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। আলহামদুলিল্লাহ মিজানকে ভারী করবে। আর সুবহানাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ আসমান ও জমিনের মধ্যভাগ পূর্ণ করবে। নামাজ একটি আলোকবর্তিকা। সদকা প্রমাণ হবে। ধৈর্য আলোকময় হবে। কোরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে সাক্ষ্য হবে। প্রত্যেকে সকাল করবে। অতঃপর হয়তো নিজেকে বিক্রয় করবে কিংবা রক্ষা করবে।
মুসলিম, হাদিস : ৩৬০
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ঘুম থেকে জাগলে সে যেন পাত্রে হাত ঢোকানোর আগে হাত ধৌত করে। কেননা, তুমি জান না, ঘুমের সময় তোমার হাত কোথায় ছিল।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৫০)
সালমান (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি তাওরাতে পড়েছি, খাবারের আগে অজু করলে বরকত হয়। অতঃপর বিষয়টি আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থাপন করি। তখন তিনি বলেন, খাবারের আগে এবং পরের অজুর মধ্যে খাবারের বরকত নিহিত।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩২৩)
অসুস্থদের সঙ্গে আচরণ যেমন হবে
আর কেউ অসুস্থ হলে তার কী করণীয়? মুসলিমদের মধ্যে যারা রোগাক্রান্ত, তাদের মুহাম্মদ (সা.) কী পরামর্শ দিয়েছেন? তিনি মানুষকে সর্বদা চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।
উসামা বিন শারিক (রা.) থেকে বর্ণিত, বেদুইনরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা কি ওষুধ সেবন করব না? রাসুল বলেছেন, হে আল্লাহর বান্দারা, হ্যাঁ, তোমরা ওষুধ সেবন করো। কেননা আল্লাহ এমন কোনো রোগ দেননি, যার কোনো ওষুধ নেই, তবে একটি রোগ ছাড়া। তারা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল তা কোন রোগ? রাসুল (সা.) বললেন, তা হলো বার্ধক্য।’ (তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ২০৪৮)
সামাজিক দূরত্ব ও ইবাদত-বন্দেগি
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তির সঙ্গে ঈমানের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও তার নির্দেশনা ছিল অনন্য। সাম্প্রতিক সময়ে অনেককে এমন কথা বলতে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্ব ও কোয়ারেন্টাইনের মতো মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের চেয়ে ইবাদত করা উত্তম। কিন্তু ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসার ক্ষেত্রে একমাত্র বা প্রধান মাধ্যম হিসেবে ইবাদতকে কীভাবে নির্ধারণ করেছেন, তা বোঝার জন্য নিম্নের হাদিসটি দেখুন।
হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর প্রখ্যাত হাদিস বিশেষজ্ঞ ইমাম আবু ইসা মুহাম্মদ তিরমিজি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত—
এক লোক এসে বলল, হে আল্লাহ রাসুল, আমি উট ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করব, নাকি তা বেঁধে আল্লাহর ওপর ভরসা করব? রাসুল (সা.) বলেন, আগে তোমার উট বেঁধে নাও, অতঃপর তোমার রবের ওপর ভরসা করো।
তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৭
মহানবী (সা.) সবাইকে পুরো জীবনে দ্বীন অনুসরণ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। পাশাপাশি সবার কল্যাণ, নিরাপত্তা ও মৌলিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাও মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশনা ছিল। মোটকথা, সবাইকে তিনি নিজের বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করতে উৎসাহ দিয়েছেন।