ইবরাহিম (আ.) হজ পালন করেছিলেন যেভাবে
হজ ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও পঞ্চস্তম্ভের একটি। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম (আ.) সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। এর পর থেকে নবী-রসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ পালনের বিধান। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘আর আমি যখন কাবাঘরকে মানুষের জন্য সম্মিলন ও নিরাপত্তার স্থান করলাম আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও। আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম ঘরটিকে খুব পবিত্র রেখো তাওয়াফকারী ও অবস্থানকারী লোকদের জন্য এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’ ( সূরা বাকারা, আয়াত, ১২৫ )
হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে কোরআনে আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভিতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যারা অস্বীকার করবে (তাদের স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।’ সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭।
হজ প্রবর্তনের আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন। কাবাঘরটি হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন। হজরত ইবরাহিম জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি নির্দেশ হলো হজব্রত পালনের।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেওয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এ কথা শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) তখন মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন।’
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ে আরোহণ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহর ইবরাহিম (আ.)-এর সেই আহ্বান জড়জগতের সীমা অতিক্রম করে রুহানি জগতে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং লাব্বাইক বলে যেসব রুহ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল আল্লাহ চান তো কিয়ামত পর্যন্ত তারাই পর্যায়ক্রমে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হবে!’ এভাবে মক্কা পরিণত হলো হজব্রত পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসেবে।
আল্লাহতায়ালা হজরত জিবরাঈল আ.-কে পাঠিয়ে হজরত ইবরাহিম আ.-কে হজের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, আপনি ও ইসমাইল (আ.) এই ঘর সাতবার তাওয়াফ করবেন। প্রতি তাওয়াফের সময় দুই রুকন চুম্বন করবেন।
অন্য বর্ণনা মতে, আল্লাহ তাআলা জিবরাইল (আ.)-কে পাঠান। অতঃপর তিনি ইবরাহিম (আ.)-কে নিয়ে হজ করেন। কোরবানির দিন ইবলিস জামারা আকাবার সামনে এসে দেখা দেয়। জিবরাইল (আ.) তাকে পাথর নিক্ষেপ করতে বলেন।
তখন ইবরাহিম (আ.) সাতটি পাথরের টুকরা নিক্ষেপ করলে ইবলিস চলে যায়। কিন্তু জামারা সুফলায় আবার ইবলিস উপস্থিত হয়। জিবরাইল (আ.) তাকে সাত পাথরের টুকরা নিক্ষেপ করতে বলেন। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) পাথর নিক্ষেপ করলে ইবলিস চলে যায়। এরপর জামারা উসতায় পুনরায় ইবলিস এসে দেখা দেয়।
জিবরাইল (আ.) তাকে তাকবির বলতে এবং পাথর নিক্ষেপ করতে বলেন। তখন ইবরাহিম (আ.) সাতটি টুকরা নিক্ষেপ করলে ইবলিস চলে যায়। এরপর তিনি আরাফা এসে পৌঁছেন। তখন জিবরাইল (আ.) জিজ্ঞাসা করেন, হে ইবরাহিম, আপনি আপনার ইবাদত সম্পর্কে জেনেছেন? ইবরাহিম (আ.) বলেন, হ্যাঁ, বুঝেছি। তখন থেকেই স্থানটি আরাফাত নাম ধারণ করে।
অতঃপর ইবরাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.) ও হারামের স্থানীয় মুসলিমদের নিয়ে পবিত্র হজ পালন করেন। তিনি তাদের নিয়ে মিনায় নামাজ পড়ে সেখানে রাত্রি যাপন করেন।
সকালে সবাইকে নিয়ে তিনি নামিরায় মধ্যাহ্ন পর্যন্ত অবস্থান করে সেখানে নামাজ পড়েন। অতঃপর আরাফার মাওকিফে অবস্থান করেন। বর্তমানে এখানেই ইমাম অবস্থান করেন। সূর্যাস্তের পর তিনি মুজদালিফায় গমন করে নামাজ পড়েন। সেখানে রাত্রি যাপন করে ফজর নামাজ পড়েন। অতঃপর সকাল হলে তিনি সঙ্গে থাকা সবাইকে পাথর নিক্ষেপের বিষয়টি শিক্ষা দেন। এভাবে হজের পুরো কার্যক্রম শেষ করেন। এরপর ইবরাহিম (আ.) শামে ফিরে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
(ইবনে জিয়া লিখিত তারিখু মক্কা আল-মুশাররফাহ ওয়াল মসজিদুল হারাম ওয়াল মদিনাতিশ শরিফাহ ওয়াল কবরিশ শরিফ, পৃষ্ঠা : ৪৭)