রমজানের পরেও যেসব আমলের প্রতি যত্নশীল হবেন
রমজানকে বলা হয় ইবাদতের বসন্তকাল। এ মাস আল্লাহর নৈকট্য ও পুণ্য লাভের সর্বোত্তম সময়। কেননা রমজান মাসে আল্লাহ রহমতের দুয়ার খুলে দেন এবং প্রতি নেক কাজের প্রতিদান বহু গুণ বৃদ্ধি করেন। এ মাসে আল্লাহর রহমত ও বরকত লুফে নিতে বেশি বেশি ইবাদতে মগ্ন হন মুসলিমরা।
রমজানের পর মানুষের মাঝে আগের মতো আমল-ইবাদতের প্রতি তেমন উদ্যমতা দেখা যায় না। অনেকে ফরজ ইবাদতগুলো পালন করতেও অবহেলা করেন। কিন্তু রমজানে আমলের এই অনুশীলন পুরো বছর ধরে রাখা উচিত। রমজান পরবর্তী সময়েও যেসব আমলের প্রতি যত্নশীল হওয়া আবশ্যক তা তুলে ধরা হলো-
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো জামাতে আদায়
রমজান, রমজানের বাইরে বাকি ১১ মাস অর্থাৎ পুরো বছর নামাজ আদায় করা ফরজ। ফরজ নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় করাও ফরজ। প্রত্যেক নামাজের জন্যই সময় নির্ধারণ করা আছে। ওয়াক্ত বা সময় চলে গেলে সে নামাজের কাজা আদায় করা যায়।
নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়লা ঘোষণা করেন- ‘নিশ্চয় নামাজকে ঈমানদারের জন্য নির্ধারিত সময়ে (আদায় করা) আবশ্যক কর্তব্য করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১০৩)
নামাজ আদায়ে গরিমসি করা উচিত নয়। নামাজ না পড়া পরকালে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘(জাহান্নামিদের জিজ্ঞাসা করা হবে) তোমাদের কোন জিনিস সাকারে (জাহান্নাম) নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। ’ (সুরা : মুদ্দাসসির, আয়াত : ৪২-৪৩)
মসজিদে বেশি যাতায়াত করা
রমজানে ইতিকাফ ও নামাজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কারণে মসজিদের সঙ্গে এক ধরনের আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠে। মসজিদে বেশি বেশি যাওয়া আসা করা হয়। মসজিদে বেশি বেশি যাতায়াতের এই গুণটি প্রশংসনীয়। রমজানের পরেও মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। কারণ, মসজিদে বেশি সময় অতিবাহিত করা ব্যক্তির জন্য আল্লাহর রাসুল সুসংবাদ দিয়েছেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা মসজিদে যায়, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতে মেহমানদারির ব্যবস্থা করেন। সকালে অথবা সন্ধ্যায় যতবার সে মসজিদে যায়, ততবারই আল্লাহ তায়ালা তার জন্য মেহমানদারির ব্যবস্থা করেন। (সহিহ বুখারি, ৬৩১, সহিহ মুসলিম, ১৫৫৬, সহিহ ইবনে খুজাইমা, ১৪৯৬, সহিহ ইবনে হিব্বান, ২০৩৭)
কোরআন তেলাওয়াত কমিয়ে না দেওয়া
কোরআন নাজিলের মাস রমজানে প্রায় সব মুসলমানই কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি যত্নশীল হয়ে থাকেন। কিন্তু রমজানের পর পুরো বছর কোরআনের সঙ্গে তেমন কোনও সম্পর্ক থাকে না। রমজানের বাইরেও পুরো বছর কোরআন তেলাওয়াত করা উচিত।
কোরআন তেলাওয়াত মানুষের মনকে প্রশান্ত রাখে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।’ (সুরা রা‘দ, আয়াত : ২৮)
কোরআন তেলাওয়াতকারীদের আল্লাহর পরিজন বলে অভিহিত করা হয়েছে হাদিসে।
আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, কিছু মানুষ আল্লাহর পরিজন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা? তিনি বলেন, কোরআন তেলাওয়াতকারীরা আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা।’ (ইবনে মাজাহ: ২১৫)
তাহাজ্জুদের প্রতি যত্নশীল হওয়া
তাহাজ্জুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের উপায়। রমজানে শেষ রাতে সেহরিতে উঠার কারণে অনেকেই সহজে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারতেন। কিন্তু বছরের অন্য সময় গভীর ঘুমের কারণে সবার পক্ষে তাহাজ্জুদ পড়া হয়ে উঠে না। কিন্তু রমজানের বাইরেও পুরো বছর তাহাজ্জুদের ফজিলত লাভে যত্নশীল হওয়া উচিত।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ধারাবাহিকভাবে তাহাজ্জুদ পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আ’স (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবদুল্লাহ! তুমি অমুক ব্যাক্তির মত হয়ো না, সে রাত জেগে ইবাদাত করত, পরে রাত জেগে ইবাদত করা ছেড়ে দিয়েছে। (বুখারি, হাদিস : ১১৫২)
গিবত পরনিন্দা থেকে দূরে থাকা
গিবত বা পরনিন্দা ব্যাভিচারের চেয়েও জঘন্যতম গুনাহমি রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে অনেকেই গিবত থেকে বেঁচে থাকলেও পুরো বছর এ নিয়ে তেমন সচেতনতা দেখা যায় না। কিন্তু গিবত মানুষের ঈমান ও আমল ধ্বংস করে দেয়। পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণ দূর করে দেয়। ইসলামে কাউকে সামনে থেকে নিন্দা করাও মারাত্মক অপরাধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত : ০১)
আয়াতে আল্লাহ তাআলা সামনে-পেছনে কারো নিন্দা বা গিবত করা অথবা সামনাসামনি কাউকে দোষারোপ করা ও মন্দ বলা জঘন্য পাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এর শাস্তিও ভয়াবহ।
একই সুরায় শাস্তির কথা বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় (জাহান্নামের একটি স্তর)। আর কিসে তোমাকে জানাবে হুতামা কি? আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন। যা হৃদপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয় তা তাদের আবদ্ধ করে রাখবে। প্রলম্বিত স্তম্ভসমূহে। ’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত : ০৪)
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আন্দাজ-অনুমান থেকে বেঁচে থেকো। কেননা অনুমান করে কথা বলা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। (বুখারি, হাদিস নং: ২২৮৭; মুসলিম, হাদিস নং: ২৫৬৩)
মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকা
মিথ্যা বলা অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া গর্হিত অপরাধ। মিথ্যাবাদীর পক্ষে যেকোনো ধরনের পাপ করা সম্ভব। কেননা সে পাপ কাজ করে খুব সহজে তা অস্বীকার করতে পারে। এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা হলো, কোনো বিষয়ে নিশ্চিত জানাশোনা না থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ে অনুমানভিত্তিক কোনো কথা বলা অপরাধ।
মিথ্যা কখনো কখনো মিথ্যাবাদীকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় এবং মিথ্যা বলতে বলতে পরিশেষে সে আল্লাহ তাআলার কাছে মিথ্যুক হিসেবে পরিগণিত হয়।
ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সর্বদা সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে এবং সর্বদা মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬০৭)
নিয়মিত দান সদকা করা
রমজানে মানুষ অধিক সওয়াবের আশায় দান-সদকা করে থাকে। রমজানের বাইরেও দান-সদকার অভ্যাস বজায় রাখা উচিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের সম্পদে গরিব-অসহায়দের অধিকার রয়েছে’। (সূরা যারিয়াত, আয়াত, ১৯)
নবীজি (সা.) বলেন, দান-সদকা গুনাহ এমনভাবে মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে। দান জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। তিনি আরও বলেন, দান করলে বিপদ কেটে যায় আর হায়াত বাড়ে।
বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর।’ দান করলে বালা মুসিবত, পেরেশানি, দুর্ঘটনা, অসুস্থতা দূর হয়ে যায়। দান-সদকা দুনিয়া ও আখেরাতের অনেক কষ্টকে দূর করে দেয়।
অসহায়দের খোঁজ-খবর রাখা
রমজান এবং রমজানের বাইরে সারা বছর সমাজের বিধবা, এতিম ও দুস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা করা বড় ইবাদত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকিনদের সমস্যা সমাধানের জন্য ছোটাছুটি করে সে যেন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত। বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাও বলেছেন, সে যেন ওই ব্যক্তির মতো, যে সারা রাত সালাত আদায় করে এবং সারা বছর সিয়াম পালন করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৯৮২)