তওবার মাধ্যমে যে নবীর উম্মতকে ক্ষমা করেছিলেন আল্লাহ
ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনা পরকালকে যেমন সমৃদ্ধ করে, দুনিয়ার জীবনকেও সুন্দর করে। ক্ষমাপ্রার্থনা কেবলই পাপ থেকে মুক্তি নয়, ক্ষমাপ্রার্থনা আমাদের সংকট, বিপর্যয় ও বিপদাপদ থেকেও মুক্তির হাতিয়ার। আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে কেউ যদি নিজের পাপ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে, চোখের পানি ফেলে কেউ যদি ক্ষমাপ্রাপ্ত হতে পারে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হবে।
আল্লাহর প্রিয় বান্দা যারা, তার রহমত ও দয়া তাদেরকে দুনিয়া-আখেরাত সর্বত্র ঘিরে রাখে। এ বিষয়ে উল্লেখ করা যায়, আল্লাহর নবি সায়্যিদুনা ইউনুস আলাইহিস সালামের কথা। তিনি পড়েছিলেন এক কল্পনাতীত কঠিন সংকটে। গভীর সাগরে এক মাছ, সে মাছের পেটের ভেতর নবী ইউনুস আলাইহিস সালাম! কয়েক স্তরের এ অন্ধকার থেকে যে দোয়ার বরকতে তিনি বেরিয়ে আসেন, তাও ছিল ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনা।
হযরত ইউনুস (আ.) –এর পরিচয়
হযরত ইউনুস (আ.) আল্লাহ তায়ালার সম্মানিত নবীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তার মায়ের নাম মাত্তা। সেজন্য তাকে ইউনুস ইবনে মাত্তা ও বলা হতো। কোরআন মাজিদে তাকে তিনটি নামে সম্বোধন করা হয়েছে। ইউনুস, জুননূন ও সহিবুল হুত। জুননূন ও সহিবুল হুত অর্থ মাছওয়ালা। কোরআনে বর্ণিত মাছ সংশ্লিষ্ট ঘটনার দিকে ইশারা করে তাকে এই নামে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান ইরাকের মাসুল নগরীর নিকটবর্তী ‘নিনেভা’ জনপদের অধিবাসীদের প্রতি তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন।
তার উম্মতের বিরোধিতা
হযরত ইউনুস (আ.) –এর উম্মতরা ছিলো পৈৗত্তলিকতার অনুসারী বা মূর্তিপূজারী। তিনি তাদেরকে দীর্র্ঘদিন পর্যন্ত মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকতে বলেন এবং সত্যের দিকে ডাকনে। তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। আল্লাহর আজাবের ভয় দেখান। সতর্ক করতে থাকেন। আদেশ উপদেশ দিতেই থাকেন।
কিন্তু তারা তার কোন কথাই শোনলো না। বরং ক্রমান্বয়ে তার প্রতি শত্রুতা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস ও অস্বীকৃতির মাত্রা বাড়াতে থাকে। অবশেষে হযরত ইউনুস (আ.) অসহ্য হয়ে তাদের জানিয়ে দিলেন যে, তোমরা এক আল্লাহ ও আমার প্রতি বিশ্বাস না আনলে এবং তোমাদের অবাধ্য আচরণ থেকে বিরত না হলে তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই তোমাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব আসবে। তিনি তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের জন্য বদ দোয়া করে তাদের জনপদ ছেড়ে চলে গেলেন।
তিনি চলে যাওয়ার পর লোকদের বিশ্বাস জন্মালো যে, নবিরা মিথ্যা বলে না। নবিদের দোয়া ব্যর্থ হয় না৷ আজাবের কিছু আলামত ও দেখা দিলো৷ ফলে তার গোত্রের লোকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শিশুদের ও পশুদের পাল নিয়ে ময়দানে বের হয়ে গেলো এবং শিশুদের থেকে মায়েদের বিচ্ছিন্ন করে দিলো৷ অতঃপর নিজেরা আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। সবার চিৎকারে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। সকলে খাঁটি মনে তওবা করল এবং মূর্তিগুলি ভেঙ্গে দিলো৷
আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা করলো৷ এমনকি হযরত ইউনুস (আ) -কে তালাশ করল যেন তার অনুসরণ করতে পারে৷ এতে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করলেন৷ এবং তাদের উপর থেকে আসন্ন আজাব উঠিয়ে নিলেন৷
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন: ‘অতএব কোন জনপদ কেন এমন হ’ল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম’ (সূরা ইউনুস : ৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুস আ -এর কওমের প্রশংসা করা হয়েছে কাতররত অবস্থায় তাদের তওবার কারণে।
মাছের পেটে যাওয়ার কারণ
ইউনুস (আ) -এর কওম তার অবাধ্যতার কারণে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আল্লাহ তায়ালার হুকুমের অপেক্ষা তিনি করেননি৷ কারণ নবিরা ওহির অপেক্ষা করেন। তাদের এই সুযোগ আছে যা সাধারণ মানুষের নেই। তার এই কাজ আল্লাহ পছন্দ করেননি৷ ফলে তাকে মহা পরীক্ষায় ফেলেছেন৷
তিনি ভেবেছিলেন তার চলে যাওয়ার পর তার কওম আল্লাহর আজাবে ধ্বংস হয়ে গেছে৷ কিন্তু তওবার কারণে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিয়েছিলেন। যা তিনি তখন জানতে পারেনি। পরে যখন জানতে পারলেন আদৌও আজাব নাজিল হয়নি তখন তিনি চিন্তিত হলেন৷ ভাবলেন, এখন যদি কওমের কাছে ফিরে যায় তাহলে তারা তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে। প্রথা অনুযায়ী মিথ্যার শাস্তি হিসেবে তাকে হত্যা করবে৷ তখন তিনি তার কওমের কাছে ফিরে না গিয়ে হিজরতের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলেন৷
মাছের পেটে
আল্লাহর অনুমতি ছাড়া যখন হিজরতের উদ্দেশ্য লোকালয় থেকে বের হয়ে একদল লোকের সঙ্গে বের হয়ে নৌকায় আরোহন করলেন৷ এবং মাঝ নদীতে ঢেউ ও বাতাসে নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হলো৷ সহযাত্রীরা এ থেকে বুঝলো নৌকায় কোন পলাতক গোলাম রয়েছে যার উপর তার মালিক অসন্তুষ্ট। তাকে ফেলতে হবে। অথবা নৌকার বোঝা কমানোর জন্য আরোহীরা একজনকে নামিয়ে দিতে চাইলো৷ কাকে ফেলবে সে লক্ষ্যে যাত্রীদের নামে লটারি করলো৷ তাতে ইউনুস আ -এরই নাম বেরিয়ে এলো৷
কিন্তু যাত্রীদের মন তাকে ফেলতে সায় দিচ্ছিল না। এজন্য দুই তিনবার লটারি ধরা হলো। বারবার তারই নাম আসতে থাকায় তিনি নিজেই নদীতে ঝাঁপ দিলেন। সাথে সাথে আল্লাহর হুকুমে একটি বড় মাছ এসে তাকে গিলে ফেললো৷ এদিকে আল্লাহ মাছকে আদেশ করলেন, তুমি তাকে তোমার পেটে ধারণ কর। কোন ক্ষতি করিও না৷ সে তোমার খাদ্য নয়। তুমি তাকে হেফাজত রেখো৷ তাই মাছ তার ক্ষতি করেনি।
আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা কোরআনে ইরশাদ করে বলেন: ‘আর ইউনুস ছিল পয়গম্বরগণের একজন’। ‘যখন সে পালিয়ে যাত্রী বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছল’। ‘অতঃপর লটারীতে শরিক হলো এবং অকৃতকার্য হল’। ‘অতঃপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল। এমতাবস্থায় সে ছিল নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল’। (সূরা আস-সাফফাত : ১৩৯-১৪২)।
মুক্তি পেলের যেভাবে
তিনি আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তার উম্মতদের রেখে বের যাওয়ার ভুল বুঝতে পেরে কাতরভাবে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন ‘আপনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, আপনি পবিত্র, নিশ্চয়ই আমি অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত’।
তিনি নিজ ভুল স্বীকার করলেন৷ তওবা করলেন। যদিও এটা তার জন্য সাধারণ ভুল ছিলো যা উম্মতের জন্য মার্জনীয় কিন্তু নবির শান উপযোগী ছিলো না। ফলে আল্লাহ পরীক্ষা নিলেন। পাকড়াও করলেন এবং তওবার পর মুক্তি দিলেন।
এরপরের বিবরণ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ধারাবাহিকভাবে দিয়েছেন, ‘অতঃপর যদি সে তাসবীহকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হত’। ‘তাহলে সে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকত’। ‘অতঃপর আমি তাকে পীড়িত অবস্থায় একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন সে রুগ্ন ছিল’। ‘এবং তার উপরে একটি লতা বিশিষ্ট বৃক্ষ উদ্গত করলাম’। ‘এবং তাকে লক্ষ বা তদোধিক লোকের কাছে রাসূল করে পাঠিয়েছিলাম’। ‘অতঃপর তারা ঈমান আনল। ফলে আমরা তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিলাম’ (সূরা আস-সফফাত : ১৪৩-১৪৮)।
আল্লাহ অন্য সূরায় বলেন, ‘এবং মাছের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি (ইউনুস আ.)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমি তার উপরে কোনরূপ কষ্ট দানের সিদ্ধান্ত নেব না’। ‘অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্য থেকে ডাক দিলো, (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘অতঃপর আমি তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি’ (সূরা আম্বিয়া - ৮৭-৮৮)।
ঘটনা থেকে শিক্ষা
ইউনুস আ -এর এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি কারো অসদাচরণ ও দুর্ব্যবহারের কারণে একজন দায়ী তথা আল্লাহর দিকে আহবানকারী ব্যক্তি নিজেকে গুটিয়ে রাখা বা চলে যাওয়া উচিত নয়। এবং আল্লাহর পরীক্ষা আসার পূর্বে অনুমান করে নিজ থেকে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা৷ আল্লাহ চাইলে যেকোনভাবে ঈমানদারকে রক্ষা করতে পারেন৷ আল্লাহর প্রতি সর্বদা আনুগত্য জ্ঞাপন করা সাথে সাথে কায়মনোবাক্যে দোয়া করতে থাকা। সর্বোপরি কোন গুনাহ বা ভুল হয়ে গেলে বিনয়াবনতভাবে তওবা ও ইস্তেগফার করতে থাকে।
বিশেষ করে একথা হাদীস দ্বারা বুঝা যায় হযরত ইউনুস (আ) যে দোয়া মাছের পেটে থাকাবস্থায় করেছেন তা যদি কোন ব্যক্তি বিপদ বা মুসিবতের সময় বিশ্বাসের সাথে পড়ে তাহলে আল্লাহ তাকে সে বিপদ থেকে হেফাজত করবেন এবং তার দোয়া কবুল করবেন। (তিরমিযী : ৩৫০৫)। এটা হলো টেনশন ও বিপদের নববী চিকিৎসা।
লেখক : শিক্ষক, মাশিকাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, দেবিদ্বার, কুমিল্লা