বদর যুদ্ধ কেন হয়েছিলো?
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র লড়াই হয় বদর যুদ্ধে। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। জালিমের বিরুদ্ধে মাজলুমের লড়াই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও ইনসাফের লড়াই। বদর যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৩)
২য় হিজরির ১৭ রমজানে এ যুদ্ধটি মুসলিমদের অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। মদীনায় হিজরতের মাত্র ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (স.)-কে মদীনা থেকে বের করে দেবার জন্য নানা অপচেষ্টা চালায়। যেভাবে তারা ইতোপূর্বে হাবশায় হিজরতকারী মুসলমানদের সেখান থেকে বের করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, (এরা হচ্ছে কিছু মজলুম মানুষ) যাদের অন্যায়ভাবে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এ কারণে, তারা বলেছিল আমাদের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা।’ (সূরা হাজ : ৪০)
মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার কাফেরদের একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা শামে গিয়েছিল।
৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধার পাহারায় এক হাজার মালবাহী উটের একটি বাণিজ্যিক বহর মদিনা অতিক্রম করে যাচ্ছে। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, এ নিয়ে নবীজী উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহবান করলেন।
মুহাজির সাহাবিদের মধ্যে হজরত আবু বকর ও ওমর (রা.) তাদের মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। অতঃপর মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রা.) দাঁড়িয়ে তেজস্বিনী ভাষায় বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মূসাকে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও যুদ্ধ করগে! আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)।،
সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে আবিসিনিয়ার ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’।
মিক্বদাদের এই জোরালো বক্তব্য শুনে আল্লাহর রাসূল খুবই প্রীত হলেন এবং তার জন্য কল্যাণের দোয়া করলেন।
সংখ্যালঘু মুহাজিরদের তিন নেতার বক্তব্য শোনার পর সংখ্যাগুরু আনসারদের পরামর্শ চাইলে আউস গোত্রের নেতা সাদ বিন মুআয (রা.) বললেন, হে রাসূল! আপনি হয়ত আশংকা করছেন যে, আমাদের সঙ্গে আপনার চুক্তি অনুযায়ী আনসারগণ কেবল (মদীনার) শহরে অবস্থান করেই আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য মনে করে।
জেনে রাখুন, আমি আনসারদের পক্ষ থেকেই বলছি, যেখানে ইচ্ছা হয় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। যার সঙ্গে খুশী আপনি সন্ধি করুন বা ছিন্ন করুন- সর্বাবস্থায় আমরা আপনার সাথে আছি। যদি আপনি অগ্রসর হয়ে হাবশার বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে যান, তাহলে আমরা আপনার সাথেই থাকব। আর যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব’। ‘আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন’।
হজরত সাদের কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সা.) খুবই খুশী হলেন ও উদ্দীপিত হয়ে বললেন, ‘চলো এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তায়ালা আমাকে দু’টি দলের কোনো একটির বিজয় সম্পর্কে ওয়াদা দান করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি এখন ওদের বধ্যভূমিগুলো দেখতে পাচ্ছি’।
এ সময় মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে মর্মে সে মক্কায় মিথ্যা খবর পাঠায় মক্কায়। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়।
কাফেরদের বাঁধা দেওয়ার জন্য মাত্র ৩১৩ জন মুসলমানের কাফেলা নিয়ে রাসূল সা. বদর প্রান্তরে উপস্থিত হন। মুসলমানদের মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি, বাকি সবাই মদিনার আনসার। ৩১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি আর ঘোড়া ছিল মাত্র ২টি।
অপর দিকে কাফিরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছেই ছিল বর্ম এবং ঘোড়া ছিল ২০০টি। ঘোরতর এ যুদ্ধেকাফিরদের পক্ষে ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হন।
আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ শীর্ষস্থানীয় নেতারা কাপুরুষের মতো মৃত্যুবরণ করে। অপরদিকে মাত্র মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনসারসহ ১৪ জন শহীদ হন। মুসলমানদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
মুসলমানদের ৩১৩ জনের ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে সেদিন পরাজিত হয়েছিল মক্কার একহাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। অথচ মুসলিম বাহিনীর জনবল, যুদ্ধ উপকরণ ছিল একেবারে সীমীত। সে সময়ের তুলনায় আজ মুসলমানদের শক্তি সামর্থ ও জনসংখ্যা অনেক বেশি। বিশ্ব শাসন করতে যা দরকার সব আল্লাহ নেয়াতম স্বরূপ মুসলিম বিশ্বেকে দিয়েছেন। তেল, স্বর্ণ, রাবার থেকে শুরু করে ভৌগোলিকভাবে নৌপথ, আকাশপথ ও স্থলপথসহ সব কিছু মুসলিমদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু এরপরও বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা এতটাই নাজুক যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও একটু টু শব্দ পর্যন্ত করার ক্ষমতা নেই।
বদর প্রান্তরে মুসলমানদের মাঝে যে ঈমানী শক্তি, ঐক্য ও মমত্ববোধ, একনিষ্ঠতা ছিল, সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে কুফুর শিরকের বিরুদ্ধে আপোসহীন ছিলেন এসবের কিছুই আজ মুসলিম বিশ্বে নেই। আছে শুধু দ্বন্ধ-কলহ, ক্ষমতার লোভ, বিলাসিতা ইত্যাদি। বিশ্বের কোনো মুসলিম দেশে ইসালামপন্থীদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য নেই। একারণেই আজ মুসলিমবিশ্ব আল্লাহর সাহায্যও মদদ থেকে বঞ্চিত।
তবে সব গ্লানি মুছে বদরের বিজয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং সাহাবায়ে কেরামের ঈমানী চেতনায় যদি উজ্জীবিত হতে পারলে আজও পৃথিবীতে ইসলামের পতাকা সমুন্নত হবে, মুসলমানদের এই দুর্দশা দূর হবে এবং সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তাই মুসলিম শাসকদের উচিৎ বদরের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মুসলিম মিল্লাতকে জালিমের কবল থেকে উদ্ধার করে আল্লাহর জমিনে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে আত্ননিয়োগ করা।
লেখক: ইসলামিক স্কলার ও মানবাধিকার কর্মী