ইসলামের ৪ খলিফা সম্পর্কে জেনে নিন
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যে এসে তৎকালীন মানুষগুলো খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার সাহাবিরা এক একজন আকাশের নক্ষত্রতুল্য। তোমরা যাকে অনুসরণ করবে তার মধ্যে সত্যপথের সন্ধান পাবে।’
তার সান্নিধ্য পাওয়া সাহাবিদের মধ্যে ইসলামের চার খলিফা ছিলেন সবার থেকে আলাদা তাদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তারা উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। বিশ্বনবীর (সা:) সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ চার খলিফার শাসনামলকে ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নবীজির পর তারা ৩০ বছর ইসলামের নেতৃত্ব দেন। তাদের শাসনকাল সম্পর্কে তুলে ধরা হল এখানে-
হজরত আবু বকর রা.
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ৫৭৩ সালে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবু কুহাফা ও মায়ের নাম সালমা বিনতে সাখার।
শৈশবকাল থেকে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর (রা.)-এর বন্ধুত্ব ছিল। রাসুল (সা.) নবুয়তপ্রাপ্ত হওয়ার পর বয়স্ক স্বাধীন পুরুষদের মধ্য সর্বপ্রথম তিনিই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুশুর ছিলেন। তার মেয়ে আয়েশা রা.- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মীনী ছিলেন।
তরুণ বয়সে আবু বকর (রা.) একজন বণিক হিসাবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। ইয়েমেন থেকে বাণিজ্য শেষে ফেরার পর তিনি মুহাম্মাদের ইসলাম প্রচারের সংবাদ পান। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ অন্য অনেকের ইসলাম গ্রহণের উৎসাহ জুগিয়েছে।
আবু বকর রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত কাছের মানুষ ছিলেন। ইসলামের প্রথম যুগে কাফের-মুশরিকদের নির্মম নির্যাতনের দিনগুলোতে তিনি আল্লাহর রাসুলের পাশে ছিলেন। হিজরতের সময় তিনিই ছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একমাত্র সঙ্গী। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সব জিহাদে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর তিনি খলিফা হন এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন।
আবু বকরের খিলাফত ২৭ মাস অর্থাৎ দুই বছরের কিছু বেশি সময় স্থায়ী ছিল। এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাকে বেশ কিছু অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হতে হয় এবং তিনি তা সফলভাবে মোকাবিলা করেন। নতুন নবী দাবিকারী বিদ্রোহীদের তিনি রিদ্দার যুদ্ধে দমন করেন। তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন, যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এসব অভিযানের ফলে মুসলিম সাম্রাজ্য কয়েক দশকের মধ্যে শক্তিশালী হিসাবে আবির্ভূত হয়। আবু বকর সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে কুরআন সংকলন করেন। ইতোপূর্বে কুরআনের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্নভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। মৃত্যুর আগে আবু বকর (রা.) কুরআনের এ কপিটি তার উত্তরসূরি উমর ইবনুল খাত্তাবকে দিয়ে যান। উমর (রা.)-এর শাসনকালে এটি তার কাছেই রক্ষিত ছিল।
পারিবারিক জীবনে তিনি স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রীতি ও সদ্ভাব রাখতেন। তার চাল-চলন ছিল সাদাসিধে, মোটা কাপড় ব্যবহার করতেন। বাহ্যিক কোনো জাঁকজমক ছিল না। জগতের আদর্শ প্রশাসক, মহানবীর সাথি খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট, ২২ জমাদিউস সানি ১৩ হিজরি ইন্তেকাল করেন। আয়েশা (রা.)- এর ঘরে মুহাম্মাদ (সা.)-এর পাশে তাকে দাফন করা হয়।
হজরত ওমর ফারুক রা.
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.)। ৫৮৩ খিস্টাব্দে তিনি কুরাইশ বংশের বিখ্যাত আদ্দি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। উমর (রা.) এর বাবা খাত্তাব কুরাইশ বংশের একজন বিখ্যাত লোক ছিলেন। উমর (রা.) এর মাতার নাম হানতামা।
হজরত উমর (রা.) শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ অগ্রসর ছিলেন। তিনি কবিতা লেখায় পারদর্শী ছিলেন। কুস্তিবিদ্যায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।
নবীজি যখন মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করছিলেন এসময় কাফের-মুশরিকেরা সত্য ধর্মের আহ্বান সহ্য করতে না পেরে নবীজীকে হত্যা করার ঘোষণা দিল। এ জন্য তারা পুরস্কারও ঘোষণা করল। এ ঘোষণার পর কেউ মহানবী (সা.) কে মারার দুঃসাহস দেখাতে না পারলেও ওমর রা রাজি হয়ে যান। কিন্তু নবীজিকে হত্যা করতে গিয়ে তিনি নিজেই প্রিয় নবীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
ওমর রা.-এর ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের শক্তিশালী করে। তার ইসলাম গ্রহণের আগে কেউ প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা বলার সাহস পেত না এমনকি মুসলমানদের কেউ প্রকাশ্যে কোরআন তেলাওয়াত করার সাহস পেত না। কিন্তু ওমর রা. ইসলাম গ্রহণের পর কাবার সামনে প্রকাশ্যে ইসলাম এবং নামাজ আদায়ের ঘোষণা দেন।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নবীজি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুখ-দুঃখ ও সমস্যাবলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বদর, ওহুদ, খন্দক, হুনাইন, খাইবার প্রভৃতি যুদ্ধে যোগদান করে অসাধারণ বীরত্ব, যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা.-এর ওফাতের পর হজরত ওমর (রা.) শাসনভার গ্রহণ করেন। তার খেলাফতকাল (৬৩৪-৬৪৪) ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। বিশ্বের সর্বকালের শাসকদের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ স্থানীয়।
হজরত ওমর (রা) শুধু একজন বিখ্যাত বিজেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক এবং নিরঙ্কুশ সফলকাম জাতীয় নেতাদের অন্যতম। এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক হয়েও হজরত ওমর (রা) সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন।
১০ বছর ৬ মাস ৩ দিন ইসলামি রাষ্ট্রের খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার শাসনকাল থেকে ব্যাপকভাবে ইসলামের বিকাশ ঘটে। তার সময়ে সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের অধীনে আসে। তার শাসনামলেই জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়।
হজরত ওমর (রা) জ্ঞান চর্চার অনুরাগী ছিলেন। বিদ্বান ও বাগ্মী হিসেবে তার সুখ্যাতি ছিল। কোরআন-হাদিসে তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। সামরিক বিজ্ঞান ও কৌশলের দিক দিয়ে তিনি সমগ্র আরবের সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ২৬ জিলহজ ২৩ হিজরি/৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে দুষ্কৃতকারীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
হজরত উসমান ইবনে আফফান রা.
হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)। তাঁর বংশধারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আবদে মানাফ পর্যন্ত গিয়ে মিলিত হয়েছে। উসমান (রা.) এর জন্ম ৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ হস্তীসনের ছয় বছর পর।
হজরত উসমান (রা.) কে বলা হয় জুননুরাইন (দুই নুরের মালিক)। এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, তিনি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।
হজরত উসমান (রা.) ছিলেন দয়ালু ও মহানুভাব একজন সাহাবি। ওমর রা.-এর ওফাতের পর তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তাকে খলিফা নির্বাচিত করা হলে তার নম্রতা ও বিনয় আরো বৃদ্ধি পায়। তিনি নিজ সম্পদ থেকে জনগণের খাদ্যের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু নিজে সিরকা ও যায়তুনের তেল ব্যবহার করতেন।
ইবনে কুতাইবা (রা.) বলেন, হজরত উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে মিশর, ইরান, আফ্রিকা, তিবরিস, রোম উপকূল, শেষ উস্তাখার, প্রথম পারস্য, তিবরিস্তান, কিরমান, সিজিস্তান, আল আসাবিয়াহ, জর্দানের উপকূলীয় এলাকা, মারভ ইত্যাদি এলাকা বিজয় হয়।
হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) সম্পর্কে আল্লাহর নবী বলেন, যাকে দেখে ফেরেশতাগণ লজ্জা পায়, আমি তাকে দেখে কেন লজ্জা পাব না? তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন। তার শাহাদাতের ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হজরত উসমান (রা.) ৮৮ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করেন। তার খিলাফাত কাল ছিল, ১১ বছর ১১ মাস ৪ দিন।
হজরত আলী রা.
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলি (রা.)। তিনি ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালিবের ছেলে এবং তার জামাতা ছিলেন। তিনি আল্লাহর রাসুলের কলিজার টুকরো ফাতেমা রা.-কে বিয়ে করেছিলেন।
আলী রা. ১০ বছর বয়সেই ইসলাম গ্রহণ করেন। বালকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদিনা যাওয়ার সময় হজরত আলি (রা.)-কে আমানতের মালের দায়িত্ব দিয়ে রেখে যান।
ইসলামের সূচনাকাল থেকেই হজরত আলী ছিলেন মহানবীর প্রিয়পাত্র। ইসলামের প্রতিটি কাজে তার অংশগ্রহণ থাকত অনিবার্য। রাসূলে পাক (সা.)-এর প্রতিটি কাজের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। মনে প্রাণেই তিনি নবী করিম (সা.)-এর কর্মকাণ্ডকে বিশ্বাস করতেন এবং মানতেন।
তিনি বদর, ওহুদ, খন্দক, বনু কোরায়জা যুদ্ধ, হোদায়বিয়ার সন্ধি, খায়বর বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, আদিউসের যুদ্ধ ও ইয়ামিনের যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করে সবার শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ইসলামের ইতিহাসে শেরে খোদা উপাধি লাভ করেন।
তিনি অনাড়ম্বর ও সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। নিজ হাতে কাজ করে উপার্জন করতেন। কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত উসমান (রা.)-এর সময় খেলাফতে প্রবল বিদ্রোহ দেখা দিলে হজরত আলী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্রোহীদের হাতে হজরত উসমান (রা.) ইন্তেকালের পর সব সম্প্রদায় এবং সমগ্র আরব জাহানের অনুরোধে হজরত আলী (রা.) খলিফা নির্বাচিত হন।
হজরত আলী (রা.) ৪ বছর ৮ মাস ২৩ দিন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে ১৭ রমজান ৪০ হিজরি/৬৬১ খ্রিস্টাব্দে কুফায় শাহাদাত বরণ করেন।