সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ করলে আল্লাহ যে পুরস্কার দেবেন
সন্তান দাম্পত্য জীবন আলোকিত করে। জীবনে স্বর্গীয় সুখ নিয়ে আসে। সন্তানকে দেখে চোখ জুরায় মা-বাবার। রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে দেহ-মন। প্রত্যেক মা-বাবার প্রত্যাশা চোখের সামনে হাটি হাটি পা পা করে সন্তান বেড়ে উঠবে, পৃথিবীতে মানুষের মত মানুষ হয়ে মা-বাবার নাম করবে। অনেক অভিভাবকের এই স্বপ্ন পূরণ হয়। আবার কারও কারও স্বপ্ন আধুরাই থেকে যায়। শৈশব-কৈশোরেই মা-বাবার আগে সন্তান পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। জান্নাতের পাখি হয়ে যায়।
সন্তানকে দেখে দেখে, সন্তানকে নিয়ে রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে বুনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পান মা-বাবা। তাই নিজেদের আগেই সন্তানের চলে যাওয়া কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেন না, মেনে নেওয়া সহজ হয় না। তবে আল্লাহ তায়ালা কখনও কখনও কোনও দম্পতিকে মহা পরীক্ষায় ফেলেন। তাদের সন্তানকে নিয়ে যান। তবে এতে হা-হুতাশ না করে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তের ওপর ধৈর্যধারণ করলে বিশেষ পুরস্কার রয়েছে।
জান্নাতে ‘প্রশংসার ঘর’!
এক হাদিসে এসেছে, হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কারও সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করে ফেলেছ?’ তারা বলেন, ‘হ্যাঁ’।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তার কলিজার টুকরার জান কবজ করে ফেলেছ?’ তারা বলেন, ‘হ্যাঁ’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা কি বলেছে?’ তারা বলেন, ‘আপনার বান্দা এই বিপদেও ধৈর্য ধারণ করে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে।’
তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমার এই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ কর এবং তার নামকরণ কর ‘বাইতুল হামদ’, অর্থাৎ, প্রশংসার ঘর।’ -(তিরমিজি সূত্রে রিয়াজুস সালেহিন : ১৩৯৫)
মা-বাবার জান্নাতে যাওয়ার কারণ
শৈশবেই মৃত্যুবরণ করা শিশুরা মা-বাবার জান্নাতে যাওয়ার কারণ হয়ে থাকে। এ বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘শিশু (অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী) মুসলিম সন্তানেরা জান্নাতের ‘শিশু খাদেম’ হবে। তারা তাদের মাতা-পিতাকে পেলে কাপড় ধরে টেনে জান্নাতে না নেওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না।’ (মেশকাত : ১৭৫২)
জান্নাতের দরজায় মা-বাবার জন্য অপেক্ষা
আরেক হাদিসে হজরত কুররা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বসতেন, তখন সাহাবিদের অনেকে তার কাছে এসে বসতেন। তাদের মধ্যে একজন সাহাবির ছোট একটি শিশুপুত্র ছিল। তিনি তার ছেলেকে পেছনে দিক থেকে নিজের সামনে এনে বসাতেন। একদিন সে ছেলেটি মৃত্যুবরণ করল। ফলে সে সাহাবি খুব বিষণ্ন হয়ে পড়লেন। ছেলের শোকে তিনি নবীজির মজলিসে উপস্থিত হতেন না।
কয়েকদিন তাকে না দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অমুক ব্যক্তিকে দেখছি না কেন?’ সাহাবিগণ বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি তার যে ছোট ছেলেকে দেখেছিলেন সে মৃত্যুবরণ করেছে।’
পরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার সে ছেলেটির কী হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে।’ তখন নবীজি (সা.) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে বললেন।
তারপর বললেন, ‘হে অমুক! তোমার কাছে কোনটা বেশি পছন্দনীয়, তার দ্বারা তোমার পার্থিব জীবন সুখময় করা; নাকি কাল কেয়ামতে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে তুমি প্রবেশ করতে চাইবে, তাকে সেখানেই পাওয়া, যেখানে সে পৌঁছে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেবে?’
তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! বরং সে আমার জান্নাতের দরজায় গিয়ে আমার জন্য দরজা খুলে দেবে; এটাই আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাহলে তোমার জন্য তাই হবে।’ (নাসায়ি : ২০৯০)
মা-বাবার জন্য রহমত
অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু মারা গেলে তারা মা-বাবার জন্য রহমত বয়ে আনে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যেকোনো মুসলিম ব্যক্তির এমন তিনটি (সন্তান) মারা যাবে, যারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি, আল্লাহ তাদের প্রতি বিশেষ রহমতে তাদের মা-বাবাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (বুখারি, হাদিস : ১৩৮১)
‘ছোট বয়সে মৃত্যুবরণকারী সন্তানেরা জান্নাতের প্রজাপতির মতো’
মা-বাবার আগে মারা যাওয়া শিশুদের জান্নাতের প্রজাপতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে হাদিসে। হজরত আবু হাসসান (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত আবু হুরায়রাকে (রা.) বললাম, ‘আমার দুটি সন্তান মারা গিয়েছে। আপনি কি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে থেকে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করবেন, যাতে আমরা অন্তরে সান্ত্বনা পেতে পারি?’
তখন আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, হ্যাঁ, আমি নবীজিকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘ছোট বয়সে মৃত্যুবরণকারী সন্তানেরা জান্নাতের প্রজাপতির মতো। তাদের কেউ যখন পিতা কিংবা পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে মিলিত হবে, তখন তার পরিধানের কাপড় কিংবা হাত ধরবে, যেভাবে এখন আমি তোমার কাপড়ের আঁচল ধরেছি। এরপর সেই কাপড় কিংবা হাত আর পরিত্যাগ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা তাকে তার মা-বাবাসহ জান্নাতে প্রবেশ না করাবেন। (মুসলিম : ৬৩৭০)
জান্নাতে ইবরাহিম (আ.) আর তার আশপাশে...
শৈশবেই মা-বাবা পৃথিবীর আলো-বাতাস ছেড়ে চলে যাওয়া শিশুরা জান্নাতে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সঙ্গে থাকে। পৃথিবীতে বন্ধু-ভাই-বোনের সঙ্গে খেলা করতে না পারলেও তারা জান্নাতের বাগানে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আশপাশে থেকে খেলা করে।
হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের স্বপ্নের বর্ণনায় বলেছেন, ‘আমরা চলতে চলতে একটা সজীব শ্যামল বাগানে এসে পৌঁছলাম, যেখানে বসন্তের বিচিত্র রকম ফুলের সমাহার রয়েছে। সে বাগানের মাঝে দীর্ঘকায় একজন পুরুষকে দেখলাম। তবে তার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম না। তার চতুর্পাশে এত বিপুল সংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে, এত বেশি আর কখনও আমি দেখিনি।
আমি ফেরেশতাদের বললাম, উনি কে? আমাকে বলা হলো, ইনি ইবরাহিম (আ.) আর তার আশপাশের বালক-বালিকারা হলো ওই সব শিশু, যারা ফিতরাতের (শৈশবের নিষ্পাপ অবস্থা) ওপর মৃত্যুবরণ করেছে।’ (বুখারি : ৪২৯)। এই বালক-বালিকারাই তাদের মা-বাবার জান্নাতে প্রবেশের কারণ হবে।
এনটি