সুখী দাম্পত্যের জন্য যেসব সুন্নত মেনে চলবেন
প্রতিটি দম্পতিই শান্তিময় জীবন কামনা করে। সংসারে বিবাদ-অশান্তি কেউ চায় না। কিন্তু দুইজন মানুষ দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকার দরুন কারণে-অকারণে রাগ-অভিমান হয়। তবে তা দীর্ঘায়িত হয়ে স্থায়ী কলহে রূপ নিলেই সর্বনাশ।
বস্তুত বৈবাহিক জীবনে সুখ-দুঃখ আসতেই পারে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো- সহজে নিরসণ করে নেওয়া। দাম্পত্য কলহ এড়াতে স্বামীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আদর্শ পরিবার গঠনেও তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাই একজন আদর্শ স্বামী হতে হলে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সুন্নত ও নির্দেশনা অনুসরণের বিকল্প নেই।
সুখময় ও শান্তিপূর্ণ এবং কলহমুক্ত দাম্পত্য জীবন পেতে হাদিসের বিভিন্ন নির্দেশনাবলি ও পরামর্শ অনুসরণীয়। নিচে কয়েকটি আলোচনা করা হলো-
ব্যক্তিগত কাজে স্ত্রীর মতামত
যেকোনো কাজেই স্ত্রীর মতামত নেওয়া চাই। অনেক সময় দেখা যায়- চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজে সঙ্গিনীর মতামত নেওয়া হয় না। আবার অনেকে গুরুত্বও দেন না। অথচ এটা অনুচিত ও অসুন্দর।
মহানবী (সা.) স্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তিনি শুধু ঘরোয়া বিষয়ে তাদের মতামত নিতেন তা নয়; বরং মুসলিম উম্মাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির ক্ষেত্রেও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে তিনি উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালমা (রা.) থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন। সেই মতামতের অসাধারণ কার্যকারিতা পরে। (বুখারি, হাদিস : ২৭৩১)
যত্নশীল হওয়া ও সময় দেওয়া
পরিবারে স্রেফ নিজের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্ত্রীকে মানসিক সহযোগিতা করা ও সঙ্গ দেওয়া—আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব। স্ত্রী-সন্তানদের সব ধরনের অধিকার পূরণ করাও তার কর্তব্য। যথাযথভাবে তাদের সঙ্গে সময় ব্যয় করাও চাই।
মহানবী (সা.) তার স্ত্রীদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সব স্ত্রীর খোঁজ নিতেন এবং সবার সঙ্গে সময় কাটাতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, ‘ফজরের নামাজের পর নবী কারিম (সা.) নামাজের স্থানে বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত লোকেরাও তার চারপাশে বসে থাকত। অতঃপর তিনি তার প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে যেতেন, তাদের সালাম দিতেন, তাদের জন্য দোয়া করতেন আর যার দিন থাকত তার কাছে গিয়ে বসতেন।’ (তাবরানি, হাদিস : ৮৭৬৪)
উকবা ইবনে আমের (রা.) বলেন, ‘আমি একদিন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে উভয় জাহানের মুক্তির পথ কী জানতে চাইলাম। উত্তরে তিনি বললেন, ‘কথাবার্তায় সংযমী হও, পরিবারের সঙ্গে তোমার অবস্থান যেন দীর্ঘ হয় এবং নিজের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হও।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০৬)
পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন থাকা
জীবনসঙ্গিনীর সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখা মুমিনের গুণ। নিজের ফিটনেস ধরে রাখাও আবশ্যক। স্বামীকে পরিপাটি ও গোছালো পাওয়া প্রতিটি স্ত্রীর অধিকার। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি; যেমনটা আমিও চাই স্ত্রী আমার জন্য সাজুক।’ (বায়হাকি, হাদিস : ১৪৭২৮)
চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা
স্ত্রীর মানসিক প্রশান্তির জন্য বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। রাসুল (সা.) স্ত্রীদের সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতুক ও আনন্দ করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, এক সফরে তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন।
রাসুল (সা.) সঙ্গীদের বললেন—
তোমরা এগিয়ে যাও। অতঃপর তিনি আয়েশা (রা.)-কে বললেন, এসো দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি তার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম এবং দৌড়ে তার চেয়ে এগিয়ে গেলাম।
(আস-সুনানুল কুবরা লিন-নাসায়ি, হাদিস : ৮৯৪৫)
সহানুভূতি জানানো
স্ত্রীরা কখনো অভিমান করলে বা মন খারাপ করলে— তাদের সহানুভূতি জানানো সুন্নত। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের প্রতি তেমন আচরণ করতেন। এক সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটু সামনে এগিয়ে যান; আর সাফিয়া (রা.) সামান্য পেছনে পড়ে যান। এতে তিনি কেঁদে ফেলেন। মহানবী (সা.) তখন নিজ হাতে তার চোখ মুছে দেন এবং কাঁদতে নিষেধ করেন।’ (সুনানে কুবরা লিন-নাসায়ি, হাদিস : ৯১৬২)
খুনসুটি ও সখ্য
মহানবী (সা.) তার আচার-আচরণে স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন। তাদের সঙ্গে নানা ধরনের খুনসুটি করতেন। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘আমি ও রাসুল (সা.) একই পাত্র থেকে গোসল করতাম যা আমাদের মধ্যে থাকত। তিনি আমার চেয়ে অগ্রগামী হলে (দ্রুত গোসল করে পানি নিলে) আমি বলতাম, আমার জন্য রাখুন! আমার জন্য রাখুন!’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩২১)
ভালোবাসা-অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ
অনেকে আচরণ ও কাজে ভালোবাসা প্রকাশ করে। কিন্তু সরাসরি কিংবা মুখে প্রকাশে লজ্জাবোধ করেন। কিন্তু উচ্চারণে ও কথার মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মহানবী (সা.)-এর সুন্নত। আল্লাহর রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময়ে স্ত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন রোমাঞ্চকর কথা বলতেন। হৃদয়াপ্লুত কথায় তাদের মুগ্ধ করতেন।
এক হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) প্রিয়তমা খাদিজা (রা.) সম্পর্কে বলেছেন—
আমার মনে তার প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে।
(মুসলিম, হাদিস : ২৪৩৫)
আয়েশা (রা.)-এর প্রশংসা করে আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন, ‘খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন সবার সেরা; নারীদের মধ্যে আয়েশা সবার সেরা।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৪১১)
আন্তরিকতা বাড়াতে সুন্দর নামে ডাকা
স্ত্রীদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আচরণ-উচ্চারণ— একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবনের শ্রেষ্ঠ উপমা। তার পবিত্র জীবনীতে স্ত্রীদের সঙ্গে আন্তরিকতা পূর্ণ ও প্রেমময় সব চিত্র দেদীপ্যমান। রাসুল-পরবর্তী সময়ে তার সম্মানিত স্ত্রীগণ আবেগ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তা বর্ণনা করেছেন। হাদিসের গ্রন্থগুলো এসবের বিশদ-ক্ষুদ্র বর্ণনা রয়েছে।
এক হাদিসে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) কখনো কখনো ভালোবেসে আমাকে হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৭৪)
ঘরোয়া কাজে সহায়তা করা
স্ত্রীকে ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করা রাসুল (সা.)-এর সুন্নত। আদর্শ স্বামীর বৈশিষ্ট্যও বটে। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেকে এটাকে লজ্জাজনক মনে করেন। অথচ এমনটা মনে করা ইসলাম সমর্থন করে না।
আসওয়াদ (রা.) বলেন, আমি একবার আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম—
রাসুল (সা.) ঘরে কী কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, অর্থাৎ গৃহস্থালি কাজে পরিবার-পরিজনের সহযোগিতায় থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো, তখন নামাজে চলে যেতেন।
(বুখারি, হাদিস : ৬৭৬)
আয়েশা (রা.) অন্য বর্ণনায় বলেন, ‘তিনি নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। নিজের জুতা নিজেই মেরামত করতেন এবং সাধারণ মানুষের মতোই ঘরের কাজকর্ম করতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৮৯)
একই পাত্রে খাবার গ্রহণ
মহানবী (সা.) স্ত্রীর সঙ্গে একই পাত্রে খাবার গ্রহণ করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমি হাড় থেকে গোশত কামড়ে নিতাম। তারপর আমি যেখানে মুখ রাখতাম আল্লাহর রাসুল (সা.) সেখানে তার মুখ রাখতেন। অথচ তখন আমি ঋতুমতী ছিলাম। আমি পাত্র থেকে পানি পান করতাম। তারপর তিনি সে স্থানে মুখ রাখতেন, যেখানে আমি মুখ রাখতাম। অথচ আমি তখন ঋতুমতী ছিলাম।’ (নাসায়ি শরিফ, হাদিস : ৭০)
ভালো কাজের স্বীকৃতি
স্ত্রী কোনো কিছু ভালো করলে তাকে সেটির স্বীকৃতি দেওয়া চাই। খাদিজা (রা.) সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তখন সে আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে তখন সে তার সম্পদ দ্বারা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, আল্লাহ আমাকে তার গর্ভ থেকে সন্তান দিয়েছেন যখন আল্লাহ অন্য স্ত্রীদের সন্তান থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৪৮৬৪)
আন্তরিকতা ও অসংখ্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর ছিল রাসুল (সা.)-এর দাম্পত্য জীবন। জীবনের সবক্যিছুর মতো একজন আদর্শ স্বামীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রেখে গেছেন তিনি।
দাম্পত্য কলহ রোধে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দুইজন মানুষের আন্তরিকতা-হৃদ্যতা, উৎস্বর্গ ও নিঃস্বার্থতা এবং ধৈর্যের মাধ্যমেই বিনির্মিত হবে একটি সুখী পরিবার। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।