ইউক্রেনে ইসলাম ও মুসলমান
ইউক্রেন এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনায়। হঠাৎ করে রাশিয়ার আক্রমণের শিকার হওয়ার আগে ইউক্রেনকে চেনার লোক বাংলাভাষায় হয়ত বহু কম ছিল। ইউক্রেন বা উক্রাইনা মূূূলত পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। রাশিয়ার পরে এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র।
দেশটির পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পশ্চিমে রোমানিয়া ও মলদোভা, দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর ও আজভ সাগর, পূর্বে ও উত্তর-পূর্বে রাশিয়া এবং উত্তরে বেলারুস। দক্ষিণে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে অবস্থিত স্বায়ত্বশাসিত ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের সীমান্তের মধ্যে পড়েছে। কিয়েভ ইউক্রেনের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।
বিপুল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ইউক্রেনের বেশির ভাগ এলাকা কৃষিকাজের উপযোগী উর্বর সমভূমি নিয়ে গঠিত। দেশটির অর্থনীতি উন্নত এবং এর কৃষি ও শিল্প খাত যথেষ্ট বড়। ইউক্রেনে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান, যেখানে রাষ্ট্রপতি হলেন সরকারপ্রধান।
ইউক্রেনের জনসংখ্যা ও মুসলিম
ছয় লাখ তিন হাজার ৬২৮ বর্গমাইলের এই দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ মিলিয়ন। এদের বেশির ভাগ মানুষ খ্রিস্টান। ইসলাম দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম। তাদের মোট জনসংখ্যার ০.৬ থেকে ০.৯ শতাংশ মানুষ এই ধর্ম পালন করে। কারও কারও মতে অবশ্য ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষ ইসলামধর্ম পালন করে।
১৫ শতাব্দীতে ক্রিমিয়ার খানাট প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্ব ছিল। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মুসলমান মূলত ক্রিমিয়ান তাতার। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে অবশ্য কিছু তুর্কি আদিবাসীও রয়েছে। আরো আছে ভলগা, আজারিস, উত্তর ককেশীয় নৃগোষ্ঠী ও উজবেকরাও।
ইউক্রেনে মুসলমানের সংখ্যা
২০১২ সালের এক পরিসংখ্যান মতে, ইউক্রেনে মুসলমানের সংখ্যা পাঁচ লাখ, এর মধ্যে তিন লাখই তাতার। ২০১৬ সালে সে দেশের মুসলমানদের সংস্থা ‘উম্মাহ’র প্রধান মুফতি সাইয়্যেদ ইসমাগিলভ দাবি করেন, ইউক্রেনে মুসলমানদের সংখ্যা এক মিলিয়ন; কিন্তু সেখানকার মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে ভিন্নমতও আছে। ২০০৯ সালে ক্লেরিকাল বোর্ড অব ইউক্রেনস মুসলিম দাবি করে, ইউক্রেনে মুসলমানের সংখ্যা দুই মিলিয়ন। (উইকিপিডিয়া, কিয়েভ পোস্ট)।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বর্তমানে (২০২২ সালে) সেখানে মুসলমানের সংখ্যা (অফিশিয়ালি) প্রায় ছয় লাখ ৯৫ হাজার, যা তাদের মোট জনসংখ্যার ১.৭০ শতাংশ।
যদিও ইউক্রেনের মানুষ জাতিগতভাবে অর্থডক্স খ্রিস্টান; কিন্তু সেখানে মুসলমানরাও তাদের সঙ্গে বহু শতাব্দী ধরে একসঙ্গে বাস করে আসছে। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মুসলমানের বাস ক্রিমিয়ার সীমানার দিকে। এছাড়াও ভলহানিয়া ও পোডোলিয়া এলাকায় কিছু লিপকা, তাতার জনগোষ্ঠীর বসবাস আছে, যারা মুসলিম।
ইউক্রেনে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য
ইউক্রেনে ইসলামের আগমনের ইতিহাস ক্রিমিয়ান তাতারদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সপ্তম শতাব্দীর দিকে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে তুর্কি বংশোদ্ভূত কিছু মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের বংশধররাই ১৫ শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ ইউক্রেনে ক্রিমিয়ান খানাট প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এটি রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সে সময় ক্রিমিয়ার বখছিসারাই শহরে ১৮টি মসজিদ ও বহু মাদরাসা ছিল; কিন্তু রাশিয়ার অত্যাচারে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মুসলিম ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়।
এরপর থেকে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে লাখ লাখ মুসলমানকে এই অঞ্চল থেকে বের করা হয়। পরে ১৯৮৯ সালে ক্রিমিয়ান তাতাররা তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন করতে শুরু করে।
ইউক্রেনে মসজিদ ও মুসলিম কমিউনিটি
এখন সেখানে মুসলমানের সংখ্যা একটু একটু করে বাড়ছে। বর্তমানে সেখানে ১৬০টি মসজিদ আছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বাড়ছে। এই অঞ্চলের প্রথম মসজিদ হলো মসজিদ আর রহমান। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালে ইউক্রেনের কিয়েভ শহরের তাতারকা পাড়ায় মুসলমানদের জন্য প্রথম মসজিদ নির্মাণ করা হয়। (উইকিপিডিয়া)
ইউক্রেনের মুসলিমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালের পর থেকে নির্বাচনে কোনো প্রার্থী না দেওয়ায় ২০১১ সালে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। (কিভ পোস্ট)
বর্তমানে ইউক্রেনে মুসলিমদের ৪৪৫টি কমিউনিটি আছে। এই কমিউনিটিগুলোতে সাধারণত নামাজের ঘর, কনফারেন্স হল, ইন্টারনেট ক্লাব, ক্রীড়া প্রশিক্ষণ হল, খেলার মাঠ ও ইসলামী বইয়ের বিশাল গ্রন্থাগার থাকে। তাদের উদ্যোগে সব বয়সী মুসলিমদের ইসলামী শিক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময় নওমুসলিমদের ইসলামী দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
ইউক্রেনে ইসলামি সাংস্কৃতিক বিষয়াদি
করোনার সময় মুসলিম কমিউনিটিগুলোর উদ্যোগে দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে খাবার বিতরণ কর্মসূচি, রক্তদান কর্মসূচি ইত্যাদি পালন করা হয়। এরই মধ্যে তারা ‘আসসালামু আলাইকুম’ নামে মুসলমানদের স্বতন্ত্র একটি রেডিও স্টেশন খুলতে সক্ষম হয়েছে। অনুরূপভাবে তাদের রুশ এবং আরবি ভাষায় ‘আর রায়েদ’ নামে সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকাও রয়েছে। রয়েছে ‘আনসার’ নামে একটি আলাদা সাংস্কৃতিক সংস্থা। এছাড়াও ইউক্রেনে তাবলিগ জামাতের কাজও চালু রয়েছে।
এভাবেই ইউক্রেনের মুসলমানরা ইসলামের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করে ইউক্রেনজুড়ে শান্তির দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছে। ২০২০ সালে সেখানকার মুসলমানদের উদ্যোগে গোটা ইউক্রেনে ২৪ ঘণ্টায় এক মিলিয়ন বৃক্ষ রোপণ করা হয়।
মহান আল্লাহ ইউক্রেনের মুসলমানদের কবুল করুন এবং তাদের শক্তিশালী করুন। তাদের মাধ্যমে ইউরোপে ইসলামের যাত্রা আরও বৃহৎ ও সুদীর্ঘ করুন।
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা।। লেখক-গবেষক, খতিব ও মাদরাসা-শিক্ষক