প্রবাসীর একুশের ভাবনা
গতকাল রাতভর প্রায় বিশ সেন্টিমিটার তুষারপাত হয়েছে। কিন্তু মন্দের ভালো যে আজ সোমবার হলেও ক্যালগারি শহর সহ সারা আলবার্টা প্রদেশে সরকারি ছুটি, কেননা প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সোমবার ‘ফ্যামিলি ডে’ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। পুরানো তুষারের উপর নতুন পড়া তুষার প্রকৃতিকে দিয়েছে শ্বেত শুভ্র আচ্ছাদন। মেঘ শূন্য আকাশকে ভেদ করে সূর্য কিরণ তুষারে প্রতিফলিত করে সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ সৌন্দর্যের যদিও বাহিরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কমপক্ষে বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে।
বেলা তিনটার মতো হবে। রিমাকে দেখা গেল ওদের বসার ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী জানালার পাশে রাখা ইজিচেয়ারে বসে আছে আর হাতে ধরা চায়ের কাপ থেকে বাষ্প উঠছে। মৃদুভাবে ইজিচেয়ারটা দুলছে আর রিমা আনমনে চেয়ে আছে বাহিরের দিকে।
কিছুক্ষণ পর তপুও এসে চেয়ার টেনে রিমার পাশে এসে বসল। মনে হল রিমা এতটাই অন্যমনস্ক যে তপুর পাশে বাসাটাও টের পেল না। তপু রিমার এই অন্যমনস্কতায় বেশ অবাক হলেও ওর বাহু স্পর্শ করে ক্ষীণ স্বরে বলল -
‘এই রিমা, আজ দেখছি তোমাকে খুব বেশি আনমনা দেখাচ্ছে। কি এত ভাবছো?’
মনে হলো তপুর স্পর্শ আর কথা বলার শব্দে রিমা যেন বাস্তবে ফিরে এলো। খানিকটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে বলল–
‘দেখো, কাল বাদে পরশু দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। আজ থেকে ঠিক তেরো আগের এক একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মাস্তান টাইপের বড় ভাইয়ের ইচ্ছাকৃত আমার গায়ে হাত দেবার বিরুদ্ধে তুমি প্রতিবাদ করেছিলে যার মধ্য দিয়ে তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।’
একটু দুষ্ট হেসে তপু বলল–
‘কেন যে সেদিন প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলাম? সেটাই তো দেখছি হয়েছে আমার কাল!’
এরপর খানিকটা তরল স্বরে তপু বলে যেতে থাকে–
‘সেই যে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। কখন যে পড়েছি প্রেমের বন্ধনে, কখন যে বেঁধেছি টুনাটুনির বাসা তা ভাবতেই আজও দেহ মনে শিহরন জাগে! শুধু কি তাই? আমার কিন্তু আজও মনে হয় আমি এখনও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বা খুব বেশি হলে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী!’
মহান একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি। দলে দলে সর্বস্তরের মানুষ নগ্ন পায়ে ফুল হাতে এগিয়ে চলে শহীদ মিনারের দিকে। পুরুষেরা পাঞ্জাবি আর নারীরা শাড়ি পরে এগিয়ে চলে। আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত আর শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত গান–
‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।’’
সারাদেশ ভাষা সৈনিকদের বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে থাকে ফুল আর পুষ্পস্তবক দিয়ে শহীদ মিনারকে সজ্জিত করে। আর ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য ত্যাগের এই প্রতীক ‘শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ’ মাথা উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গিতে ঘোষণা করতে থাকে জাতি হিসাবে আমরা কতটা অদমনীয় আর অপ্রতিরোধ্য! কাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই শুরু হয় আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আর কবিতা আবৃত্তির মেলা।
তপুর বাক্যালাপ শুনে রিমার মনটাও কেমন জানি ঝলমল করে ওঠে। সেটাকে এক প্রকার চাপা রেখে রিমা বলল–
‘আসলে আমি ভাবছি একুশ এলেই আমাদের সেই সময়ে সারা দেশ কেমন জানি দেশের প্রতি ভাষার প্রতি এক প্রকাণ্ড রকমের আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তো। তারুণ্য ভরা সেই দিনগুলো কেন জানি ফিরে পেতে ভীষণ মন চায়।’
‘দেখো রিমা, এখানেও তো একুশ উদযাপিত হয়। বাংলাদেশ-কানাডা সেন্টারে অস্থায়ী শহীদ মিনারে সন্ধ্যায় ফুল দেওয়া আর ভাষা বিষয়ক সভা-সেমিনারে আমরাও তো যোগ দিয়ে থাকি। আমাদের শহরের প্রবাস বাংলা ভয়েস পত্রিকা ‘অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি’ নামে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করে থাকে, তাই না?’
রিমার কেন জানি তপুর কথার পিঠে কথা বলতে ইচ্ছা করল না। ওর মনে পড়ল এই তো কয়েক বছর আগের কথা। ও আর তপু গিয়েছিল এক প্রবাসী বাংলাদেশি দম্পতির বাসায় সান্ধ্যকালীন এক নিমন্ত্রণে। দেশি খাবার আর প্রাণের ভাষা বাংলাতে এক জমজমাট আড্ডা। এই ধরনের আড্ডাতে সাধারণত পুরুষ আর নারীদের আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে গল্প-গুজব করতে দেখা যায়। কিন্তু সেদিনের আড্ডাতে সব মিলে তিনটি পরিবার থাকাতে সবাই একসাথে বসেই আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছিল।
আলাপের একপর্যায়ে বয়স্ক এক ভদ্রলোক রিমা আর তপুর উদ্দেশে বলেছিলেন–
‘আচ্ছা, তোমরা দুজনেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করছো। …আসলে আমাদের বিবাহযোগ্য মেয়ের জন্যে একটা ভালো দেশি ছেলে খুঁজছিলাম। তোমাদের জানামতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে তেমন কেউ কি আছে?’
উত্তরে তপু বলেছিল–
‘তা আপনারা কোন ধরনের পাত্র খুঁজছেন? বাংলাদেশ থেকে আসা ছাত্র ভিসাধারী না কানাডিয়ান স্থায়ী বাসিন্দা (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) বা বাংলাদেশি-কানাডিয়ান কেউ?’
‘সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলেই চলবে। তবে আমরা চাই ছেলেকে অবশ্যই বাংলাতে কথা বলতে হবে।’
বাংলার কথা বলতেই রিমা তড়িঘড়ি করে বলেছিল–
‘তা চাচা, বাংলার বিষয়ে আপনাদের এমন বাধ্যবাধকতা কেন?’
খানিকটা আমতা আমতা করে ভদ্রলোক বলেছিলেন–
‘না, মানে নাতি-নাতনিরা আমার আর আমার স্ত্রীর সাথে বাংলায় কাটুস-কুটুস করে কথা বলবে, এটাই আমাদের চাওয়া।’
ভদ্রলোকের কথা শুনে রিমা আর তপু নিজেদের মাঝে চোখাচোখি করেছিল যেন একে অপরের কাছে জানতে চাইছিল কি জবাব দেবে। কিছুটা সময় চুপ থেকে রিমা বলেছিল–
‘তা চাচা, আপনাদের তো দুইটা ছেলে মেয়ে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু কেন বলতো?’
‘না, মানে বলছিলাম ওরা কি আপনাদের সাথে বাংলায় কথা বলে?’
‘কি যে বল না! আমরা ওদের সাথে বাংলা ছাড়া কথাই বলি না। আর ওরাও আমাদের সাথে বাংলাতেই কথা বলে থাকে।’
‘খুবই ভালো কথা, চাচা। ...আচ্ছা ওরা দুই ভাইবোন যখন নিজেদের ভেতরে কথাবার্তা বলে, তখন কি বাংলায় না ইংরেজিতে বলে?’
ভদ্রলোক এবার বেশ গর্বের সাথে বলেছিলেন–
‘কেন, ওরা সবসময়ই নিজেদের মাঝে ইংরেজিতেই কথাবার্তা বলে। বাংলায় কেন বলবে?’
ভদ্রলোকের কথা শুনে রিমা কি বলবে বা কি বলা উচিত সেদিন ভেবেই পায়নি। সে শুধু মনে মনে ভেবেছিল যে নিজেদের সন্তানরাই যখন নিজেদের মাঝে মাতৃভাষায় কথা বলে না আর সন্তানের সন্তান বাংলাতে কথা বলবে, এর নিশ্চয়তা কেই বা দিতে পারে?
সেদিনের এ কথাগুলো আজ মনে পড়তেই রিমার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির একটা আভাস দেখা গেল। আর সেটা দেখেই তপু বলে উঠল–
‘এই রিমা, সেই কতক্ষণ হলো আমার কথার কোন উত্তর তো দিলেই না, বরং নিজে নিজে কেমন জানি হেসেই চলেছো। ব্যাপারটা কি?’
‘আরে, তেমন কিছু না। এই, তুমি কি লক্ষ্য করেছো আমাদের মতো প্রবাসীদের দ্বিতীয় প্রজন্ম কেন জানি মা-বাবা ছাড়া অন্যদের সাথে বাংলায় কথা বলতে চায় না বিশেষ করে ওরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক বা আঠারোতে পদার্পণ করে।’
রিমার প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে তা তপুর কাছে ঠিক পরিষ্কার না। তাই সে বলল–
‘তা তুমি কি কখনও ভেবে দেখেছো কেন এমন হয়?’
‘দেখো, আমার মনে হয় দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানরা দুইটি সমস্যাতে ভোগে। প্রথম হলো ওরা মা-বাবার বাইরে বাংলাতে কথাবার্তা বলার সুযোগ পায় না বললেই চলে। আর দ্বিতীয় হলো ওদের সারাদিনের একটা বড় অংশ কাটে স্কুলে, সেখানে তো ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চ ছাড়া অন্য ভাষাতে শিক্ষাদান তেমন একটা করানো হয় না।’
‘তুমি ঠিকই বলেছো। এই যদি হয় দ্বিতীয় প্রজন্মকে ঘিরে, তবে তার পরবর্তী প্রজন্মগুলোর ব্যাপারে কোনো আশা করাই তো শুধু দুরাশা বইতো আর কি হতে পারে!’
এই ফেব্রুয়ারিতে তুষার আচ্ছাদিত শান্ত হিম শীতল ক্যালগরি শহর ভাষা দিবসের প্রাণবন্ত উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার যোজন দূরে। তবুও রিমার মনে হয় ভৌগোলিক দূরত্ব আর শীতলতম আবহাওয়া ওদের পরিবার, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের চেতনাকে রাহুর মতো গ্রাস করতে পারেনি। সে যেন আরও বেশি বেশি তার শিকড়ের সাথে গভীর থেকে গভীরতম সংযোগ অনুভব করে, যা তার দেহ মনে এক অজানা উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়।