প্রবাসীদের ঋণ দিতে কেন এত অনীহা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের?
বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। দেশের অর্থনৈতিক সংকটেও প্রবাস থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে সুখবর বয়ে আনেন তারা। দেশের রিজার্ভ-শূন্যতা পূরণ হয় প্রবাসীদের টাকাতেই।
অথচ প্রবাসীদের অভিযোগ, তারা দেশে ছুটিতে এসে বিপাকে বা বিপদে পড়লে পাশে পান না কাউকে। প্রবাসীদের কল্যাণে বাংলাদেশ সরকার প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক চালু করলেও ব্যাংকটিতে ঋণ সহায়তার জন্য গিয়ে হতাশ হয়ে বাড়িতে ফেরেন প্রবাসীরা।
তাদের দাবি, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ঋণের নামে প্রবাসীদের সঙ্গে তামাশা করছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে তারা শর্ত বেঁধে দেয়। সেগুলো পূরণ করতে না পারায় ঋণ জোটে না বেশিরভাগ প্রবাসীর ভাগ্যে।
জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে প্রবাসীদের ঋণ নিতে হলে তিনটি ডকুমেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দেখাতে হয়– বাংলাদেশি পাসপোর্ট, বাংলাদেশের এনআইডি এবং যে দেশে থাকেন সে দেশে কাজের বৈধ আকামা বা ভিসা। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করেন। এরপর ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হলে আরও কিছু শর্তপূরণ করতে হয়– প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিতে হলে দুজন সরকারি চাকরিজীবীর সাক্ষী ও গ্যারান্টি চেক; দুই লাখ টাকা ঋণ নিতে হলে দুজন ব্যবসায়ীর সাক্ষী ও গ্যারান্টি চেক; এক লাখ টাকা ঋণ নিতে হলে একজন ব্যবসায়ীর সাক্ষী ও গ্যারান্টি চেক দিতে হয়।
আরও পড়ুন
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের চাওয়া ডকুমেন্টের কিছুটা পূরণ করতে পারলেও সরকারি চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীর সাক্ষী ও গ্যারান্টি চেকের শর্ত পূরণ করতে পারেন না বেশিরভাগ প্রবাসী। আবার কেউ কেউ এনআইডি নিয়েও জটিলতায় পড়েন। সে কারণে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণ সহায়তাও প্রবাসীদের ভাগ্যে জোটে না।
এমনই একজন ভুক্তভোগী কাতার প্রবাসী সজীব দাস। দেশে ছুটিতে এসে পারিবারিক সমস্যার কারণে ঋণ সহায়তার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ শাখায় যান। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের চাওয়া সব ডকুমেন্ট দিতে না পারায় তাকে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
সজীব বলেন, আমার বাংলাদেশের পাসপোর্ট আর কাতারের ভিসা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের এনআইডি নাই। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে বাংলাদেশের এনআইডি করতে পারিনি। এনআইডি ছাড়া ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু সজীব নন, তার মতো অনেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে গিয়ে ঋণ সহায়তা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী চট্টগ্রামের আক্কাস আলী বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের চাওয়া সব ডকুমেন্ট দিয়েছি। তবে, সরকারি চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীর সাক্ষী ও গ্যারান্টি চেক দিতে পারিনি। তাই আমাকে ঋণ দেয়নি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
তিনি বলেন, আমার ব্যাংকের চেক আর আমার ভাইয়ের ব্যাংকের চেক দিতে চেয়েছি, তারা নেয়নি। আমি বিদেশি থাকি, সরকারি চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীর সাক্ষী ও গ্যারান্টি চেক কে দেবে আমাকে?
আরও পড়ুন
কাতার প্রবাসী সিলেটের ইলিয়াস মিয়া বলেন, দেশে ছুটিতে যাওয়ার পর মায়ের চিকিৎসা করাতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে ঋণের জন্য গিয়েছিলাম। তাদের চাওয়া সব ডকুমেন্ট দিতে না পেরে মাল্টিপল কোম্পানি থেকে বেশি সুদে টাকা নিয়ে মায়ের চিকিৎসা করি।
তিনি আরও বলেন, প্রবাসীদের বিপদে আসলে কেউ নেই, সরকার প্রবাসীদের জন্য বহু কিছু করবে বা করছে বলে বিভিন্ন সময় খবরে দেখি। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না।
কাতারে বাংলাদেশি কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব হাজী বাসার সরকার বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের নিয়মকানুন প্রবাসীদের মতামত নিয়ে করা। ঋণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়মকানুন পূরণ করা একজন প্রবাসীর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পর দেশে ছুটিতে গিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী কোথায় পাবে। সরকারের উচিত সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীর পরিবর্তে প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষী ও গ্যারান্টি চেক নিয়ে ঋণ দেওয়া।
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা জামানতবিহীন ঋণ দিই, সে কারণে গ্যারান্টার এমন একজন হতে হবে যিনি ঋণটা পরিশোধ করতে পারবেন। কারণ, এটা পাবলিকের টাকা, তাদের তো এটা ফেরত দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী আমরা প্রবাসীদের জামানতবিহীন ঋণ দিচ্ছি। গ্যারান্টার সরকারি চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী হতে হবে, এমন নয়। গ্যারান্টার ঋণ পরিশোধের যোগ্য হলেই আমরা ঋণ দিই।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা মা কিংবা ছোট ভাইকে গ্যারান্টার করতে চান, যাদের হয়তো কোনো আয় নেই। সেক্ষেত্রে আমরা ঋণ দিতে পারি না। প্রবাসীদের ঋণ দিতে আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করি। গত ১০ বছরে এ ব্যাংক থেকে ঋণ হয়েছে ৫১৫ কোটি টাকার মতো। গত তিন বছরে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৩০০ কোটি টাকা। আমরা ঋণ দিচ্ছি বলেই এটা বাড়ছে।
এসএসএইচ