সিডনিতে কেমন হলো হাসন রাজার আয়োজন?

হাসন রাজাকে নিয়ে প্রবাসে অনুষ্ঠান করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার, দরকার অনেক লোকবল ও সঠিক পরিকল্পনা। তবে এসব চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটিয়ে দিব্যি উৎসবের রং ছিটিয়েছে হাসন রাজা পরিষদ। সিডনি ভিত্তিক এ পরিষদ প্রথমবারের মতো করলো এ আয়োজন, দেখালো পেশাদারিত্ব। তাদের খুঁটিতে জোর লাগিয়েছে পথ প্রোডাকশন। সবমিলিয়ে চমৎকার আয়োজন। হাসন রাজা উৎসব ঘুরে এসে লিখেছেন নির্জন মোশাররফ
বিজ্ঞাপন
শনিবার (৯ ডিসেম্বর), সিডনিতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, একটু ভ্যাপসা গরম। আমি গণমাধ্যমের মানুষ হিসেবে যাচ্ছি আয়োজনটি কাভার করব বলে। ভদ্রলোকের পোশাকে নিজেকে আচ্ছন্ন করেছি, তাতে যেন ফেঁসে গেলাম। মনে হলো, এসির মধ্যে থাকলেই একটু আরাম হবে, তেমনটি হলো। সন্ধ্যা গড়াতেই হাজির হলাম ব্রায়ান ব্রাউন থিয়েটারে। পরিচিত অনেক মুখ। গতানুগতিক কুশল বিনিময় হলো। অনেকে একটু আগ্রহ করে ভালো-মন্দটা জিজ্ঞেস করতে আসেন, গণমাধ্যমে কাজ করে এটাই প্রাপ্তি। একটু পরেই দেখা হলো প্রধান দুই আয়োজকের সঙ্গে। এত দূর থেকে অনুষ্ঠান কাভার করতে এসেছি বলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। সন্ধ্যা ঘনাতেই শুরু হলো আয়োজন, একটু দেরি করেই শুরু হলো, ঠিক সময়ে দেশীয় অনুষ্ঠানগুলো তেমন একটা শুরু হয় না। এমনটা এখানেও হলো। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম, দর্শনার্থীর সংখ্যা কম। মন ভরল না। তবে মঞ্চে স্মার্ট উপস্থাপিকা চেষ্টা করলেন দর্শক মাতাতে। শুদ্ধ উচ্চারণ ও সুন্দর বাচনভঙ্গিতে জানান দিলেন প্রফেশনাল প্রোগামের উপস্থাপনা করছেন তিনি। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, ভালো কিছুই হবে। শুরুতেই তিনি ডেকে নিলেন মূল আয়োজক দম্পতিকে– সোলায়মান আশরাফী দেওয়ান ও তার স্ত্রী শ্রাবন্তী কাজী।
বিজ্ঞাপন
দুজনে একসঙ্গে মঞ্চে এলেন, বজায় রাখলেন শিষ্টাচার। প্রথমে শ্রাবন্তী কাজী কথামালা শুরু করলেন। ও হ্যাঁ। ওনার সম্পর্কে একটু বলে নিই, তিনি শিক্ষাবিদ, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল একাডেমির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মঞ্চে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাসন রাজাকে নিয়ে তথ্যভিত্তিক বক্তব্য দেন। আমার ভালো লাগল।
তিনি শেষ করতেই এবার বক্তা হলেন সোলায়মান আশরাফী, জানালেন তিনি হাসন রাজার বংশধর। বিনয়ীভাবে বললেন, ওনার ভাষায় সিলেটের কিছু প্রভাব আছে, তবে আমার কাছে অতটা লাগেনি। হাসন রাজাকে নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চান, হাসন রাজার প্রকৃত সৃষ্টি যেন বিকৃত না হয় সেটি নিয়েও কাজ করবেন– এমনটি তিনি জানালেন। এই দম্পতি সহজে স্বীকার করে নিলেন নিজেদের সীমাবদ্ধতা, বললেন যেকোনো ভুলকে ক্ষমা সুন্দর করে দেখতে। প্রথমবারের মতো আয়োজন, যেমনই হোক, হাসন রাজার আয়োজন, ভিন্ন স্বাদের আশায় আমার মতো হয়ত অনেকে অনুষ্ঠানে মনোযোগী হয়ে গেলেন।
বিজ্ঞাপন
মঞ্চে শুরু হলো সাংস্কৃতিক আয়োজন, প্রথমেই গানের আসর। ঢোল, তবলা, গিটার সেই সঙ্গে আরও সব অনুষঙ্গ। আমি কাউকে চিনি না। তবে ওনারা সবাই সিডনির স্থানীয় শিল্পী। গানের সুরে হলরুম গমগম করে উঠল। স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যে সিডনির চারু শিল্পীগোষ্ঠীর আয়েশা কলি, রোখসানা ও আনিসুর রহমান দম্পতি গান করেন। তাদের সঙ্গে গানের পর্ব আরও টেনে ধরেন হাসন রাজার আরেক বংশধর, হাসন রাজা ফাউন্ডেশনের সভাপতি ‘এহসান রেজা’। বেছে বেছে সবাই গান ধরলেন। এহসান রেজা সুর তুললেন ‘কি ঘর বানাইব আমি শূন্যেরও মাজার..’। কত চেনা গান। গান শুনে দর্শক সারিতে থাকা অনেকের মতো আমিও নড়ে চড়ে বসলাম। যেন মনে হলো, হাসন রাজার অনুষ্ঠানের আমেজটা একটু বেড়ে গেল।
এখানে আরও তাল লাগালেন একুশে পদকপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর সহধর্মিণী দীপ্তি রাজবংশী। তিনি হাসন রাজার গান ও অন্যান্য লোকসংগীত নিয়ে আসেন, চেনা সুরে ভাসান আমাদের। বয়স হয়েছে, তবে সুরের শৈল্পিকতা কমেনি। যদিও তিনি বললেন, আমার বয়স হয়েছে, আগের মতো গলাটা নেই। উপস্থাপিকা আমার মতোই ভাবলেন, বললেন আপনার মিষ্টি সুর আমাদের বরাবরের মতোই মুগ্ধ করেছে। সময় বাড়ছে, আমি একটু আধটু করে ছবি ও ফুটেজ নিচ্ছি। চারপাশে তাকিয়ে দেখি এখন আর তিল ধারণের ঠাঁই নেই, হাউজফুল। সিডনির মানুষরা কথা রেখেছেন। যদিও আয়োজকরা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, টিকিট সম্পূর্ণ বিক্রি হয়ে গেছে। ঠিক তেমনটি এখন যেন দেখছি। ভালো লাগছে, হাউজফুল দর্শকদের ভিড়ে আমি একেবারে সামনের সারিতে, ভিআইপি টিকিটটি আগে থেকেই আমার জন্য বরাদ্দ করে রাখা ছিল। যাই হোক, মঞ্চের কথায় ফিরে যাই, উপস্থাপিকা শিল্পী দীপ্তি রাজবংশীকে বললেন, আমরা আপনাকে সম্মানিত করতে চাই, বলে স্টেজে ধরে রাখলেন ওনাকে, ওই ফাঁকে মঞ্চে ডেকে নিলেন বাংলাদেশি নারী কাউন্সিলর সাজেদা আক্তারকে। দর্শকদের সব চোখ মঞ্চের দিকে, সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিলেন সাজেদা আক্তার।
এরপর শুরু হলো পথ প্রোডাকশনের আয়োজন, নাটক পিঞ্জিরা। গানের পর একটু ভিন্নতা। শুরু হলো নাটক। একজন ড্রিংক করছেন, পাশে এক নারী ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে দিব্যি নেচে যাচ্ছে। আমার যেন কেমন খটকা লাগল। হাসন রাজার প্রোগ্রামে এটা কি হচ্ছে। যাই হোক দেখতে লাগলাম। বড় সেট আপ, দ্রুত সিন পরিবর্তন হচ্ছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে কাহিনীর সঙ্গে মিল রেখে দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। নাটক শুরু হওয়ার আগে অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলে রেখেছিল এই নাটক একটি কল্পিত কাহিনি। ধীরে ধীরে হাসান রাজার বিষয়গুলো সামনে আনা হলো। প্রবাসে থেকে অপসংস্কৃতিতে ডুবে থাকা কিছু মানুষের গল্প বলা হলো, গল্পের মূল চরিত্রটি তার ভুল বুঝতে পেরে একসময় দেশীয় সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হয়। সবমিলিয়ে পথ প্রোডাকশন তাদের কাজটা কেন ভিন্ন সেটি করে দেখাল। বেশ কিছু নাচের সমন্বয়ে দর্শকদের বিনোদিত করার চেষ্টাটাও রেখেছে এই টিম। পিঞ্জিরা ও পাখী সেই সঙ্গে সিলেটের চা বাগানের নান্দনিক দৃশ্য যেন নয়ন জুড়িয়েছে। গ্রুপ ড্যান্সে বেশ কিছু মেয়ে নাচছিল, তখন পেছন থেকে কেউ আমার পাশের সিটে এসে বসল আর বলল, এখন আমার মেয়ে নাচবে, এ দৃশ্যটা নিতেই হবে, তাই সামনে চলে এসেছি। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, তিনিও একজন গণমাধ্যম কর্মী, চেনা মুখ আমাদের সিমি আপা। ওনার সঙ্গে গল্প হলো। বললেন, মেয়েকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করতে দিয়ে ভালো লাগে।
পিঞ্জিরার গল্পের রেশ কাটাতে শুরু হয় বিরতি। বিরতিতে হলের বাইরে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ে, দেখা যায় খোশ গল্প আর চিরচেনা আড্ডা। কেউ কেউ কিছু স্ন্যাকস কিনে খাচ্ছেন, আবার কেউবা চা। সবমিলিয়ে এক উৎফুল্ল পরিবেশ। এভাবে সময় যখন ফুরিয়ে যাচ্ছে, হলের স্পিকারে বিনীত ভাষায় কেউ যেন ডাকছে, আসনে ফিরে যেতে হবে সবাইকে। তবুও অনেকে ব্যস্ত, ছবি তুলবে বলে। বাইরের দিকটা হাসন রাজার থিমে সাজানো, আমি চাইছিলাম কিছু ছবি নেব এখানকার। নৌকা, ঘোড়া, সিংহাসন অনেক কিছুর উপস্থিতি রাখা হয়েছে, উৎসুক নারীদের জন্য যেন আর হলো না।
স্পিকারের সুউচ্চ স্বরে বলা হচ্ছে মঞ্চে উঠবেন প্রধান আকর্ষণ শিল্পী সেলিম চৌধুরী। এই শুনে সবাই নিজে আসনে ফিরে যেতে লাগল, আমিও ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দেখি শেরওয়ানি পড়া, রাজকীয় অবয়ব নিয়ে মঞ্চে কথা বলছেন সেলিম চৌধুরী। হাসন রাজার অবদান ও তাকে শিল্পের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে বলছেন তিনি, সেই সঙ্গে স্মরণ করলেন লেখক হুমায়ূন আহমেদকে। আমি চারপাশে তাকালাম। আশপাশে সিডনির অনেক গুণী মানুষ। বসে আছেন, তাদের কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। ছবিতে দেখলাম চেনামুখগুলো উঠে আসছে– গামা আব্দুল কাদির, অজয় দাশগুপ্ত, শেখ শামীমুল হক, মো. রহমাতুল্লাহ, আব্দুল মতিন, ইব্রাহীম খলিল মাসুদ, সাবরিন ফারুকি, শাহেজামান টিটু, নাইম আব্দুল্লাহ, ইকবাল ইউসুফ টুটুল, নোমান শামীম, রতন কুন্ডু, আব্দুল খান রতন, সৈয়দ মোর্শেদ, মৌসমী সাহা, তিশা তানিয়া, পূরভি পারমিতা বোস, আরিফ রহমান, আমিনুল রুবেল এমন অনেক প্রিয়মুখ। ওইদিকে সেলিম চৌধুরী হাসন রাজাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হুমায়ূন আহমেদের অবদানের কথা বলে যাচ্ছেন।
আমি আবার মঞ্চের দিকে মনোযোগী হলাম, খেয়াল করছি সেলিম চৌধুরী বেশ প্রফেশনাল, দম রেখে হাসন রাজার জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করলেন। সেই সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সতীর্থদের– লিড গিটার, বেস গিটার, কিবোর্ড, অক্ট্যাপ্যাড, বায়া-তবলা, জিপসী, মন্দিরা ও অন্যান্য যন্ত্রসংগীতে ছিলেন তমাল, রাসেল, শাহরিয়ার, হাসান, নীলাদ্রি, রাসনা, নামিদ ফারহান প্রমুখ।
তারপর বললেন, ওনার প্রিয় কিছু গান করতে চান, দর্শক সারিতে থাকা মানুষের উৎসাহের যেন কমতি নেই। চাদনি পসরে সহ আরো বেশ কিছু হৃদয় ছোয়া গানের মুগ্ধ শ্রোতা হলাম। শেষ করতে চাইলেন সেলিম চৌধুরি কিন্তু না, কেউ যেন চেঁচিয়ে উঠলেন, আরও গাইতে হবে, আবদারটা বুঝে আরও কিছু গান করলেন সেলিম। এবার শেষ করতে হবে, আয়োজকরা সেলিম চৌধুুরীকে মঞ্চে রেখে ডেকে আনলেন সিডনির বাংলাদেশ হাইকমিশনের কনস্যুলেট জেনারেল মো. সাখাওয়াত হোসেন ও চ্যান্সেরি প্রধান কনসাল আশফাক হোসেনকে, ওনারা সেলিম চৌধুুরীকে তুলে দিলেন সম্মানসূচক ক্রেস্ট। এই ছবিটা যেন সবার চাই, শত শত মোবাইলের ক্যামেরা মঞ্চের দিকে। প্রফেশনাল ছবির কারিগর ও সাংবাদিকরা তো আরও তৎপর।
আমিও কয়েকটা ছবি ক্লিক করে নিলাম, তারপরই চটজলদি বের হয়ে গেলাম হল থেকে, দর্শকদের বের হওয়ার দৃশ্য ও শেষ অনুভূতিগুলো দেখার জন্য। তখন বাইরে ডেকরেটর কানিতাসের টিম তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। আহা কি সুন্দর ছিল বাইরের দিকটা। প্রাচীন জমিদার বাড়ির আবহে সাদা ঘোড়ার থিমে চিত্রকল্প, হাসন রাজার মূল বাড়ি ও সিলেটের হাওর অঞ্চলের দৃশ্য এমন আবহ তৈরি করে যাতে দেখা যায় সেলফি ও দলীয় ছবির হিড়িক।
বড্ড ক্লান্তি, অনুষ্ঠান শেষ। আজকের মতো এখানে লেখাও শেষ করব, তবে এটাও আপনাদের জানাতে চাই, এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সোলায়মান আশরাফী দেওয়ান ও শ্রাবন্তী কাজী দুজনেই অনেক শ্রম দিয়েছেন। শ্রাবন্তী কাজী অনুষ্ঠানের পর থেকে অসুস্থ, ভর্তি হতে হয় হাসপাতালেও। ও হ্যাঁ, তাদেরই প্রতিষ্ঠান প্রভাত ফেরী, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি ও স্ট্যামফোর্ড এডুকেশন আর্থিক জোগান দিয়েছে। আরেকজন মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থেকেও আড়ালে থাকতে চেয়েছেন, তিনি সাবেক কাউন্সিলর শাহে জামান টিটু। সবমিলিয়ে ছোট পরিসরে প্রফেশনাল প্রোগাম, আয়োজকদের বিনয়ী মনোভাব, সবাইকে এক করার মানসিকতা আমার মনে ধরেছে। হাসন রাজার অনুষ্ঠান আরও বড় পরিসরে হোক, বেঁচে থাকুক বাংলা সংস্কৃতি।
নির্জন মোশাররফ : ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও সংগঠক।