বৈশ্বিক ঈদের শাশ্বত ধারা
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। বছর ঘুরে মুসলিম বিশ্বে আবার এসেছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সাম্য, ন্যায় আর ভ্রাতৃত্বের মহান বারতা নিয়ে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আজ ঈদ উৎসবের আমেজ।
গত কয়েক বছরে বদলে গেছে পুরো পৃথিবী। তুচ্ছ একটা ভাইরাস গ্রাস করে নিয়েছিল পুরো পৃথিবীকে। সবকিছুর মধ্যেই তৈরি করে দিয়েছিল অলিখিত এক বাউন্ডারি। মানুষ চলতে পারবে, তবে নিয়মের বাইরে গেলেই ভাইরাস ছোবল দিবে তার চিরায়ত নিয়মে। এই বৈশ্বিক মহামারি পৃথিবী থেকে যেন সব আনন্দ তুলে নিয়েছিল। সে শোক কাটিয়ে পৃথিবী ফিরে এসেছে আবার তার আপন ধারায়। মুসলিম জাহানের আজ বইছে আনন্দের জোয়ার! এসেছে ঈদ!
কবির ভাষায় বলতে মন চায়, ‘আমির ফকির এক হয়ে যায় যে ঈদে, আয় না সবাই যাই ছুটে যাই সে ঈদে। এমনি করে থাকি সবাই জীবন ভর, যাই ভুলে যাই উঁচু-নিচু, আপন-পর।’
দীর্ঘ একমাস তারাবির নামাজ, সাহরি, ইফতার, জাকাত-ফিতরা, ইবাদত বন্দেগীসহ সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে পার করার পর মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য উপহারস্বরূপ এই ঈদুল ফিতর।
কবি নজরুলের ভাষায়, ‘ঈদের আনন্দ আজ সকলের মাঝে পড়ুক ছড়িয়ে। হিংসা-বিদ্বেষ, ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মিলিত হই ঈদের এই সীমাহীন আনন্দ-উৎসবে।’
ঈদুল ফিতর বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব। দিনটি মুসলমানদের জন্য বরকতময়ও। এই ঈদের প্রবর্তক হচ্ছেন মানবতার মুক্তির দূত হযরত মোহাম্মদ (সা.)। হিজরি দ্বিতীয় সন থেকে মুসলমানেরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করে আসছেন। হাদিসে আছে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই উৎসবের দিন আছে। আর আমাদের উৎসব হলো ঈদুল ফিতর।’
ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা গোসল শেষে পাক পবিত্র হয়ে সাধ্যমত নতুন ও পরিষ্কার জামা কাপড় পরিধান করে খুশবু আতর লাগিয়ে পবিত্রতার সঙ্গে পারলে একটু মিষ্টিমুখ করে সুন্দর, পরিবেশে ঈদের জামায়াতে শরিক হন। ঈদের জামাতে আখেরি মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে পাপ মুক্তি চেয়ে এবং নিজের ও দেশের কল্যাণ কামনা করে প্রার্থনা করেন।
ঈদের নামাজের পর পরই শুরু হয় ঈদের সামাজিক ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা। পরিচিত অপরিচিত সবার সঙ্গেই কোলাকুলি,শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা। ধনী বা গরীব, কালো বা সুন্দর বুকে বুক মিলিয়ে আপন করে নেন একে অপরকে।
পবিত্র ঈদ উল ফিতর যেন বৈষম্যহীন এক মিলনমেলা। ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর মিলনমেলার এক আবহ তৈরি হয়। এ সময় ধনী-গরিব কোন ব্যবধান থাকে না। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম এই ঈদুল ফিতর। প্রতিবছর ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে সবাই শরিক হয় এই আনন্দ উৎসবে। যে যার সাধ্যমতো এই দিনটি আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করে থাকে। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে মানুষে-মানুষে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পথের বিড়ম্বনা অগ্রাহ্য করে সবাই ছুটে যায় পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের কাছে।
দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মুসলমান নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির শিক্ষায় পরিশীলিত হয়। তাকওয়ার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন জীবন শুরুর উদ্দীপনা পায়। তাই ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে, বন্ধুত্ব ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। ঈদ আসে মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে, পরিশোধিত হৃদয়ে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লাগাতে। তাই ঈদের আনন্দ সংক্রমিত হতে থাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। দুস্থ, হতদরিদ্র, এতিম, নিঃস্ব ও ছিন্নমূল মানুষের মুখেও এই পবিত্র দিনে হাসির ফোয়ারা দেখা যায়। মুসলমানদের এই খুশির দিনটিকে পরম আনন্দে ভাগাভাগি করে নেয় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও। আর এভাবেই সর্বজনীন হয়ে ওঠে ঈদ।
ঈদুল ফিতর একাধারে আনন্দ উৎসব ও ইবাদত। এই আনন্দ আল্লাহর অশেষ রহমত ও ক্ষমা প্রাপ্তির, জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এই আনন্দ সিয়াম-কিয়ামের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার। এই আনন্দে নেই কোনো পাপ। আছে কেবলই উন্নত জীবনের এবং জীবনবোধের আহ্বান। ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি শেখারও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। এই উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের আরও কাছাকাছি আসে। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও।
মোহাম্মদ ইরফানুল ইসলাম।। গণমাধ্যমকর্মী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে
এটি