হেলেনায় শুরু মুরাদে শেষ
করোনা মহামারিতে সামাজিক কর্মকাণ্ডে সোচ্চার থাকলেও সাংগঠনিক কাজে ভাটা পড়ে আওয়ামী লীগের। বিদায়ী বছরে সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দলীয় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও মনযোগী হয়ে ওঠে দলটি। তৃণমূল পর্যায়ের সম্মেলনের পাশাপাশি নানামুখী কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ। তবে বছরজুড়ে থেমে থেমে পড়তে হয়েছে নানামুখী বিতর্কে। যা দলের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে, বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে সরকারকে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ ফারুক খান বলেন, আমি মনে করি, ২০২১ সাল আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুবই কঠিন সময় ছিল। কোভিড-১৯ এর কারণে বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের মনে যে শঙ্কা- এগুলো কাটিয়ে আমরা পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে কোভিড-১৯ কে সফলভাবে মোকাবিলা করেছি।
আরও পড়ুন : মেয়র জাহাঙ্গীরের পরিণতি হচ্ছে আব্বাসের!
তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশ শুরু করতে না পারলেও আমরা ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করি ফেব্রুয়ারি থেকে। একইসঙ্গে জনগণকে সচেতন করেছি ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য। পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো মাত্র ১০-১৫ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে। আমাদের দেশে ৫০ শতাংশের উপরে মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বে এ ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যেও আমরা আমাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পেরেছি। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল এবং মেট্রোরেল সব কাজই প্রথম দিকে কিছুটা স্থবির হলেও পরবর্তীতে গতি পেয়েছে। ফলে আমরা দেখেছি করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী মাইনাস গ্রোথ সেখানে আমাদের গ্রোথ প্লাস ছিল সিক্স পয়েন্টের এর মতো। বিশ্ব ব্যাংকসহ পৃথিবীর সকল আর্থিক সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে। সব মিলিয়ে আমি বলব সবাই মিলে সফলতার সঙ্গে এ কঠিন সময় পার করেছি।
এদিকে দলটির ৭৮ সাংগঠনিক জেলা কমিটির মধ্যে ৪২টিই মেয়াদোত্তীর্ণ রয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে পাবনা, নাটোর, রাজবাড়ীসহ কয়েকটি জেলার সম্মেলন হয়েছে। এছাড়াও ২০২১ সালে রাজশাহী বিভাগের ২৭ উপজেলার সম্মেলন শেষ হয়। ঢাকা বিভাগের কয়েকটি উপজেলারও সম্মেলন সম্পন্ন হয়।
বছরজুড়ে বিভিন্ন ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচনে গৃহবিবাদ বেড়েছে আওয়ামী লীগে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলকে নির্বাচনে দেখা যায়নি। যার কারণে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের নির্বাচনী লড়াইয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও রক্তপাত হয়েছে চোখে পড়ার মতো। এমপি লীগ, ভাই লীগ, জেলা-উপজেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজস্ব বলয় তৈরির প্রতিযোগিতায় প্রাণ দিতে হয়েছে অন্তত ৯২ জনকে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৭ হাজার নেতাকর্মী।
সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮ ইউপিতে নির্বাচন হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় সারাদেশে ৭ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ১ হাজার ১টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়। এতেও সহিংসতায় একজন বিজিবি সদস্যসহ ১০ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক। গত ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে ৯৪০ ইউপিতে ও ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ৭০৭ ইউপির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। ৬ষ্ঠ ধাপে ২১৯টি ইউপির নির্বাচন হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি।
বছরজুড়ে বিভিন্ন ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচনে গৃহবিবাদ বেড়েছে আওয়ামী লীগে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলকে নির্বাচনে দেখা যায়নি। যার কারণে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের নির্বাচনী লড়াইয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও রক্তপাত হয়েছে চোখে পড়ার মতো।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, মহামারির কারণে আওয়ামী লীগ গত বছর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড কম করতে পেরেছে, তবে সামাজিক কর্মকাণ্ড আমাদের ছিল। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই জনগণকে সচেতন করা, জনগণের পাশে থেকে চিকিৎসা সহায়তা করা, যারা মারা গেছেন তাদের সৎকারসহ সব ধরনের সহায়তা ছিল। আর্থিক সহায়তা করা, খাদ্য সহায়তা করাসহ সব ধরনের সহায়তা ছিল। পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে দলটি। এ বছর বিভিন্ন জেলার একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে সম্মেলন করা হয়েছে। বলা যেতে পারে করোনা মহামারির মধ্যে এ বছর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এবং সামাজিক তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
আরও পড়ুন : ‘আমাকে মেরে ফেলবে, আমাকে বাঁচান প্লিজ’ ৯৯৯ এ মুরাদের স্ত্রী
বছরজুড়ে নানা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বেশ আলোচনায় ছিলেন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হেলেনা জাহাঙ্গীর, গাজীপুর সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান।
বছরের মাঝামাঝি ‘আওয়ামী চাকুরিজীবী লীগে’ যোগ দিয়ে আলোচনায় আসেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। সফল এ ব্যবসায়ী গত এক দশকে রাজনীতিতে নিজেকে জাহির করতে গিয়ে মূলত হোঁচট খেয়েছেন বারবার। প্রথমে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটিতে নির্বাচন করার আগ্রহ দেখিয়ে পোস্টারিং করে আলোচনায় আসেন। পরে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পদ বাগিয়ে নেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সরকারের বিভিন্ন এমপি-মন্ত্রীর সঙ্গে তার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ‘আওয়ামী চাকুরিজীবী লীগে’ যোগ দিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন তিনি। সমালোচনার পারদ যখন তুঙ্গে, তখন হঠাৎ তার বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে তার বাসা থেকে বিদেশি মদ, অবৈধ ওয়াকিটকি সেট, ক্যাসিনো সরঞ্জাম, বিদেশি মুদ্রা ও হরিণের চামড়া জব্দ করা হয়। যদিও মদের লাইসেন্স ছিল তার ছেলের। এসব বিষয় সামনে এনে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করা হয়। বেশ কয়েকদিন রিমান্ডে ও নেওয়া হয় তাকে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় গাজীপুর সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের একটি অডিও ক্লিপ। যেখানে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করেন। এ নিয়ে গাজীপুরে সড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীর আলমের বিচার চেয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগের একাংশ। এক পর্যায়ে কেন্দ্র থেকে তাকে শোকজ করে। সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। সিটি মেয়র পদ থেকেও তাকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮ ইউপিতে নির্বাচন হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় সারাদেশে ৭ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ১ হাজার ১টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়। এতেও সহিংসতায় একজন বিজিবি সদস্যসহ ১০ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক।
বছরের শেষ দিকে সমালোচনার খোরাক ছিল তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ১ ডিসেম্বর রাতে ফেসবুক লাইভে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করেন। এ ঘটনায় বিএনপি তার পদত্যাগ দাবি করে।
৬ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুরাদ হাসানের সঙ্গে চিত্র নায়ক মামনুন হাসান ইমন ও নায়িকা মাহিয়া মাহির একটি ফোনালাপ ভাইরাল হয়। যেখানে তিনি মাহিয়া মাহির সঙ্গে অশ্লীলভাবে কথা বলেন এবং তার কাছে যেতে বলেন। ওই কথোপকথনে প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। পুরো বক্তব্যে ‘অশ্রাব্য’ কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়। বিষয়টি দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে তাকে প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৭ই ডিসেম্বর ইমেইলের মাধ্যমে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তবে পদত্যাগপত্রে তিনি ‘ব্যক্তিগত কারণের’ কথা উল্লেখ করেন। তাকে প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর জেলার আওয়ামী লীগের কমিটির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর তিনি দেশ ত্যাগ করে কানাডায় চলে যান। কানাডায় প্রবেশ না করতে পেরে দুবাই হয়ে তিনি ১২ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, বিদায়ী বছর ছিল দুর্ভাগ্য, দুঃখ, মানুষের জীবন রক্ষা, মানবসেবা ও কোনো রকমে সার্ভাইভ করার বছর। চারদিকে করোনার ভয়াল থাবা, লকডাউন, অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক চাপ সামাল দিতে হয়েছে। করোনা ও ক্ষুধা থেকে মানুষকে রক্ষা করার ভয়াবহ চাপ সামলাতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে।
এইউএ/এসকেডি