ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ‘বিব্রত’ আ. লীগ
শেরপুর সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত ১৪ প্রার্থীসহ ৫৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ছয় ইউপিতে সাতজন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ মো. আতিউর রহমানের বড় ভাই মো. ইসমাইল হোসেন মোটরসাইকেল প্রতীকে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তিনি কামারিয়া ইউনিয়ন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
শুধু ইসমাইল হোসেন নন, দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে এমন প্রায় ৯০০ বিদ্রোহী প্রার্থীর সন্ধান পাওয়া গেছে। যা আগে কখনও দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৃণমূলের এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলপর্যায়ের নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতারা বিব্রত হচ্ছেন তৃণমূল নেতাদের দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গের কারণে। অন্যদিকে, তৃণমূল পরিচালনায় যোগ্য ও ত্যাগী কর্মীদের মনোনয়ন দিতে না পারায় বিব্রত স্থানীয় নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির সভাপতিমণ্ডলী ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা ইউনিয়নে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকেন। সেখান থেকে একজনকে মনোনীত করা হয়। মনোনয়নবঞ্চিতরা দলের আদর্শ মানলেও কোনো কোনো জায়গায় এ সিদ্ধান্ত অমান্য করা হয়। সেক্ষেত্রে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হলেও এটা কিন্তু কোনো সমাধান নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে সারাদেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন। এখানে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় ৯০০। এসব প্রার্থীর পেছনে দলের মন্ত্রী ও এমপিরা মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। অনেক জায়গায় প্রভাবশালীদের আত্মীয়-স্বজন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বলেও জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। বিষয়টি দলের হাইকমান্ড দেখছে।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিদ্রোহীদের বিষয়ে আমাদের আগেই সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে। যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন, আগামীতে কখনও তারা নৌকা প্রতীক পাবেন না।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। পার্টির নিজস্ব ওয়েতে, নিজস্ব সেল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। যেখানে যেখানে অভিযোগ আছে, সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিষয়গুলো দেখছেন।
করোনায় স্থগিত থাকা প্রথম ধাপের ১৬০টি ইউপিতে ভোট হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। ওই নির্বাচনে সহিংসতায় কক্সবাজারে দুজন নিহত হন। ১১৯টি ইউপিতে জয়ী হন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা। বাকিগুলোতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হন।
কোথায় কোথায় বিদ্রোহী প্রার্থী
দ্বিতীয় ধাপে যশোরের ঝিকরগাছায় ১১টি ইউপিতে নির্বাচন হবে। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী ১৪ জন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে আটটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে যশোর- ২ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য নাসির উদ্দীনের ভাই ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম গিয়াস উদ্দীনও আনারস প্রতীকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এছাড়া চৌগাছার ১১ ইউপিতে ১৯ বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন।
রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ীর ১৬টি ইউপিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে তানোরের সাতটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৩৪ জন এবং গোদাগাড়ীর নয়টি ইউনিয়নে ৩৮ জন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দুই উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আছেন ২৪ জন।
তানোরের কলমা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাইনুল ইসলাম নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন রাজশাহী- ১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর চাচাত ভাই ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খাদেকুন্নবী বাবু চৌধুরী।
বাদ যাননি আওয়ামী লীগ নেতারাও
আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। লালমনিরহাটের আদিতমারীর আটটি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ছয়টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। সারপুকুর ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য নীল কমল রায়। একই ইউপিতে আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি বাদশা আলমগীর।
কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় ১৭টি ইউপিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দুই উপজেলায় ১৩ বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন শারমিন আক্তার। তার বিপরীতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ারুজ্জামান বিশ্বাস।
ভেড়ামারায় জুনিয়াদহ ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান, ধরমপুরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হক এবং চাঁদগ্রামে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মজিবুল হক বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।
মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের ১১ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে আটটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৩ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মো. শাহাদাৎ হোসেন জয়মন্টপ ইউনিয়নে আবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এ ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুই সাংগঠনিক সম্পাদক মো. বোরহান উদ্দিন ফকির ও মো. অলি আহমেদ মোল্লা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
যেখানে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই
স্বস্তির বিষয় হলো চার জেলায় আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। এর মধ্যে রাজবাড়ীর দুটি, হবিগঞ্জের পাঁচটি, খাগড়াছড়ির ১০টি ও রাঙ্গামাটির ১১টি ইউপির একটিতেও আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই।
বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি যেখানে
নওগাঁর ২০টি ইউপির বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ৪২ বিদ্রোহী প্রার্থী পাওয়া গেছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জের ১৭ ইউপিতে ৩৫ জন, পাবনার ১০ ইউপিতে ৩৩ জন, নেত্রকোনার ২৬ ইউপিতে ৩৬ জন, নরসিংদীর ১২ ইউপিতে ৩২ জন এবং সুনামগঞ্জের ১৯টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের ৩৩ বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
কেন বিদ্রোহী হলেন, যা বলছেন প্রার্থীরা
বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রায় সবাই বলছেন, তারা নিজ নিজ ইউনিয়নে জনপ্রিয়। নেতাকর্মীদের চাপে তারা প্রার্থী হয়েছেন। অনেক জায়গায় দলীয় প্রার্থীদের বিদ্রোহীদের নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আটাবর ইউনিয়নে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী এম এ আলীম। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বাঘরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল ইসলাম। ওই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আবু নাসের তানজিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক সাধারণ সম্পাদক বলেন, মেম্বার হওয়ার যোগ্য নন তিনিও চেয়ারম্যান প্রার্থী হচ্ছেন। দলীয় প্রতীক দেওয়ার কারণে এ জটিলতা তৈরি হয়েছে। মার্কা দেওয়ার আগে এটা ছিল না। লোকাল নির্বাচনে মার্কার (প্রতীক) প্রতি একটা আবেগ থাকে। এ কারণে সমস্যা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গোষ্ঠীগত প্রভাব, আঞ্চলিকতাসহ নানা ধরনের ফ্যাক্ট (বাস্তবতা) থাকে। ধরেন, আমি চেয়ারম্যান আছি, আমি নৌকাটা পেলাম না কিন্তু আমি আওয়ামী লীগ করি। আরেকজন নিয়ে গেল নৌকা। তখন আমি আমার প্রভাব-প্রতিপত্তি রক্ষার জন্য চেষ্টা করব। এমন অনেক জটিলতার কারণে বিষয়টা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
‘এটা মনে রাখতে হবে যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনটা একেবারেই তৃণমূলের বিষয়। এখানে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে একটা বিভেদ তৈরি হয়। এক সময় এ বিভেদ গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে রূপ নেয় এবং স্থায়িত্ব পায়। বিভিন্ন দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সময় এর প্রভাব পড়ে। এ কারণে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে তৃণমূলে জটিলতা তৈরি হয়। কেন্দ্রে বসে যেটা বোঝা মুশকিল।’
তিনি আরও বলেন, আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২/৩ জনের বেশি প্রার্থী পাওয়া যেত না। এখন ১০/১৫ জন প্রার্থী হচ্ছেন। কারণ, প্রতীক পেলে তো জয় নিশ্চিত। অনেক সময় সঠিক প্রার্থীও নির্বাচন করা যায় না। উপজেলা কমিটি প্রার্থী নির্বাচন করে পাঠিয়ে দেয় জেলায়, জেলা পাঠিয়ে দেয় সেন্ট্রালে। সেন্ট্রাল (কেন্দ্র) ইউনিয়নের প্রার্থী কীভাবে চিনবে? অনেকে আবার তদবির করে টাকার বিনিময়ে সেন্ট্রাল থেকে প্রতীক নিয়ে আসেন। দেখা যায় তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন। এ কারণে জটিলতা আরও বাড়ে। আমার মনে হয়, দলীয় প্রতীক ছাড়া তৃণমূলের এ নির্বাচন হওয়া উচিত।
এইউএ/এমএআর/