অপপ্রচারে লবিস্ট নিয়োগ : পেছনে বিএনপি ও জামায়াতের রাজ্জাক
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আদালতের রায়ে ইতোমধ্যে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের একাধিক নেতার। বিদেশে বসবাস করা ওইসব নেতার সন্তানরা এবং ব্যারিস্টার রাজ্জাকসহ বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা সেখানে বসে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সরকারের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ‘গণভবনে’ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলীয় প্রধান আরও বলেন, ‘টাকা বিনিয়োগ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে, আলজাজিরা ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাকে দিয়ে বিদেশে কুৎসা রটানো হচ্ছে।’ সরকারের বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার প্রতিরোধে প্রথমে উকিল নোটিশ, পরে মামলা করতে নেতাদের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাদের মন্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যাইনি করোনার কারণে। এবারও যেতাম না। বেশির ভাগ কার্যক্রম ভার্চুয়ালি হবে। তবুও যাচ্ছি কারণ, সেখানে একসঙ্গে অনেক দেশের সরকারপ্রধান উপস্থিত থাকবেন। সরকারের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চলছে তার জবাব দিতে যাচ্ছি।’
কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় গুরুত্ব পায় দলের সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়ও। আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের কার্যক্রমের ওপর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সেখানে।
শাজাহান ও নাছিমের বাহাস
সভায় প্রধানমন্ত্রীর সামনেই বাহাসে জড়ান দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সমস্যা নিয়ে বাহাসে জড়ান তারা। এ প্রসঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে শাজাহান খান বলেন, রাজৈর উপজেলায় আরেক শাহজাহানের মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বিশেষ অতিথি হিসেবে এস এম কামাল হোসেন ও শাহাবুদ্দিন ফরাজি যাচ্ছেন। কিন্তু আমি ওই এলাকার এমপি, আমি জানি না।
এ বক্তব্যের জবাবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ‘শাজাহান খান খুনির দল করেছেন’— এমন দাবি করে বলেন, ‘উনি এত মানুষকে হত্যা করেছেন, এত মানুষকে অত্যাচার করেছেন, যেখানে আওয়ামী লীগ আছে সেখানে উনি ডিস্টার্ব করেন। ওনার জন্য প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা আওয়ামী লীগ করতে পারেন না। বিএনপি-জাসদ সব উনি পালেন।’
এ সময় দুই নেতাকে থামিয়ে দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
অবশ্য, পরে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানকে। দলীয় সভাপতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমি যা করি সেটা আপনি জানেন। আমি জাসদ করতাম। আমি যখন অন্য দলে ছিলাম, আমি কি আপনার কথা শুনিনি?’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এ সময় বলেন, ‘নাছিম (বাহাউদ্দিন নাছিম), আমি তো বলেছিলাম শাজাহান খানকে দলে এনো না। তুমি (বাহাউদ্দিন নাছিম) আর দাদা ভাই (ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী) মিলে শাজাহান খানকে দলে নিয়ে আসলে। আমাকে বললে যে শাজাহান খান জাসদে বসে আমাদের সহযোগিতা করে। তুমি এখন এত কথা বলো কেন? তোমরা মিলেমিশে দল করো না কেন? উনি (শাজাহান খান) তো আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ওনার কথা তো শুনতে হবে। সেটা তো শুনো না। তোমার বয়স কম। তুমি অনেক কিছু জানো না।’
শাজাহান খানের কাছ থেকে অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সহযোগিতা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৮৬ সালে আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাদের সহযোগিতা করেছেন। নির্বাচনে যখন আমরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করি তখন উনি জাসদের সংসদ সদস্য ছিলেন। আমার কথায় তিনি পদত্যাগ করেন। ২০০১ সালের কথা ভুলে যাও কেন? তুমি (বাহাউদ্দিন নাছিম) গোপালগঞ্জ থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলে। শাজাহান খানকে যখন আমি ফোন করি, তিনি গোপালগঞ্জ যাওয়ার পর অত্যাচার বন্ধ হয়।’
‘মাদারীপুরে তো কেউ হাত দিতে পারেনি, গোপালগঞ্জের লোকজনকেও তিনি রক্ষা করেছেন। তারপর, খালেদা জিয়া যখন তাণ্ডব চালায় তখন তো উনি কাজ করেছেন। মিলেমিশে কাজ করো, তোমরা দুজন যদি মিলে যাও তাহলে আর সমস্যা হয় না।’
সভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মাদারীপুরের কারা কারা আছ? উনি (শাজাহান খান) এখন থেকে মুরুব্বি। আপনি মুরুব্বি হয়ে যান। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করেন। একজন-দুজন বাছাই করতে যাইয়েন না।’
‘শাজাহান ভাই আপনাকে বলি, আপনি এতবার আওয়ামী লীগের এমপি হলেন, প্রেসিডিয়াম মেম্বার হলেন কিন্তু আওয়ামী লীগ তো হতে পারলেন না। আপনি জাসদই রয়ে গেলেন। আপনি শুধু আপনারটা বাছাই করেন কেন? আপনি সবাইকে ধরেন। আপনি তো অভিভাবক, ওরা তো আর আপনার চেয়ে বয়সে বড় না।’
এ সময় সভায় হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
ছাত্রলীগ ‘চান্দা’ ওঠায়
সভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম অভিযোগ করেন, সহযোগী সংগঠনের ওপর তো আমাদের হাত নাই। আমরা করিও না, আপনার (দলীয় সভাপতি) নির্দেশনাও নাই। কিন্তু ছাত্রলীগ যেভাবে চলছে, ঢাকায় বসে বসে কমিটি দিয়ে দেয়। আমি তো সাক্ষী না, প্রমাণও নাই। বিভিন্ন জেলা থেকে চাঁদা ওঠায় মোটা অঙ্কের। তারপর কমিটি বিক্রি করে ঢাকায় বসে। বিএনপি-জামায়াত, কার ঘরের ছেলেকে দিয়েছে (পদ দেওয়া), এটার কোনো খোঁজ-খবর নাই।
বারবার ক্ষমা পেলে দলের বদনাম হয়
পাবনা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীর বিরোধিতা করায় ১৮ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। তারা পদ ফিরে পেতে আবেদন করেছেন। তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
এ প্রসঙ্গে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আব্দুর রহমান বলেন, ‘এভাবে শাস্তি দিয়ে পরে ক্ষমা করলে সমস্যা হয়। এ বার্তা তৃণমূলে গেলে বদনাম হয়। তারপরও আপনি (আওয়ামী লীগের সভাপতি) বিবেচনা করবেন। কয়দিন পরপর ক্ষমা পেয়ে যাবে, এমনটা যেন না হয়।’
ভবিষ্যতে শৃঙ্খলা মানবে, ‘বন্ড সই’ নিয়ে ক্ষমা করে দাও
এ প্রসঙ্গে সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, তাদের তো শাস্তি হয়েছে। ছয় মাস ধরে বহিষ্কার রয়েছে। তারপরও এ ধরনের কাজ আর কোনো দিন করবে না— এমন শর্তে যদি বন্ড সই দেয়, তাহলে দল করার সুযোগ পাবে।
শিমুল দানব হয়ে গেছে
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল একসঙ্গে বসেন না। তারা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেন। এমন অভিযোগ উত্থাপন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।
কেন্দ্রীয় নেতারা এ সময় অভিযোগ করেন, শিমুল দানব হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় নেতারা ফোন করলেও তিনি গুরুত্ব দেন না। ডাকলে আসেন না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম শফিকুল ইসলাম শিমুলের পক্ষ নিয়ে বলেন, সেখানে বিএনপি-জামায়াতকে মোকাবিলা করে শিমুল। বিএনপির নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু শিমুলকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।
নাটোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘নেত্রী আপনি সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেন। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।’ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘তুমি শিমুলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?’
সেখানে ‘মুন্সিগঞ্জ’ শাসন চলে
মুন্সিগঞ্জের সাংগঠনিক কার্যক্রম তুলে ধরে মির্জা আজম বলেন, ‘এখানে সংগঠনের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এক ব্যক্তির শাসন চলে। সেখানে আপনার (শেখ হাসিনা) শাসন চলে না। চলে মুন্সিগঞ্জের শাসন।’
১২ বছর সরকারে থাকলে অনেক দল হারিয়ে যায়
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সভায় বলেন, দল শক্তিশালী না হলে সরকারও শক্তিশালী হয় না। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। শৃঙ্খলা না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে, আমি সবাইকে নিয়ে দল করতে চাই। ঐক্যের কোনো বিকল্প নাই।
তিনি বলেন, ১২ বছর ক্ষমতায় থাকলে অনেক দল হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ আদর্শ নিয়ে কাজ করে বলে এখনও টিকে আছে।
আমি চাই তোমাদের সঙ্গে থাকতে
সকাল ১০টায় শুরু হওয়া ওই সভা শেষ হয় বিকাল সাড়ে ৩টায়। দীর্ঘদিন পর সবাইকে পেয়ে সভা আরও দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন নেতা সভা শেষের তাগিদ দিলে প্রধানমন্ত্রী হেসে দেন। বলেন, ‘আমি চাই তোমাদের সঙ্গে থাকতে। হ্যাঁ, তোমরা বাসাবাড়িতে যাবা, পরিবার নিয়ে হাওয়া খাবা। আর আমায় গণভবনের বন্দিজীবনে রেখে যাবা।’
এইউএ/এমএআর/