সংবিধান বাতিল করে জুনে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি বিপ্লবী পরিষদের
বর্তমান সংবিধান বাতিল করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠন করে জুনের মধ্যে গণপরিষদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ।
শনিবার (৪ জানুয়ারি) রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক নাগরিক সমাবেশে সদ্যগঠিত দলটির রাজনৈতিক প্রধান মো. আনিছুর রহমান বিপ্লবের রূপরেখা শীর্ষক এক প্রস্তাবনায় এ দাবি জানান।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, নির্বাচিত গণপরিষদ ছয় মাসের মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে ও দুই দফা খসড়া প্রকাশের পর ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান চূড়ান্ত হবে। এর তিন মাসের মাথায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ বলছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি শাসিত বিপ্লবী সরকার হবে চার বছর মেয়াদি। এর একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা থাকবে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে সামনে রেখে রাষ্ট্রপতির ফরমান বলে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এছাড়াও দলটি বিপ্লবী সরকারের সময়ে রাষ্ট্রপতিকে চেয়ারম্যান ও সেনাপ্রধানকে ভাইস চেয়ারম্যান করে একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতাদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কাউন্সিল গঠন করতে প্রস্তাব করেছে।
আরও পড়ুন
সমাবেশে আনিছুর রহমান বলেন, বিপ্লবী সরকারের সর্ব প্রথম কাজ হবে জুলাই গণহত্যা, পিলখানা ও শাপলা চত্বর ম্যাসাকার, গুম-খুনসহ মানবাধিকার হরণের সব অপরাধে জড়িতদের সরকার ও দলগতভাবে সুপ্রিম কমান্ড রেস্পন্সিবিলিটিসহ বিচার করতে হবে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবিতে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ আয়োজিত এ নাগরিক সমাবেশে জুলাই গণহত্যা, পিলখানা ও শাপলা চত্বর ম্যাসাকারের শহীদের পরিবারের সদস্য ও আহতরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশ উদ্বোধন করেন আশুলিয়ায় পুলিশ ভ্যানে পুড়িয়ে ফেলা শহীদদের একজন শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা আখতার। তিনি বলেন, অন্য শহীদের মায়েরা তাদের সন্তানের লাশ দেখতে পেলেও আমি আমার ছেলের লাশটিও দেখতে পারিনি। খুনি হাসিনা আমাদের সন্তানদেরকে কত কষ্ট দিয়ে মারলো, অথচ এখন পর্যন্ত তার কোনো বিচার হয়নি।
মুন্সীগঞ্জের শহীদ সজলের ভাই প্রশ্ন রাখেন, আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের এখনো কেন বিচারের আওতায় আনা হলো না?
শহীদ মোবারক হোসেনের পিতা মোহাম্মদ রমজান আলী হত্যাকারীদের বিচার দাবী করে বলেন, ঘটনাস্থলে অনেকগুলো সিসি ক্যামেরা আছে, অনেক ফুটেজ আছে। সেসব দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন কিছু না। আমরা শহীদদের বাবারা শান্তি পাচ্ছি না, কারণ আমরা আমাদের সন্তানদের খুনের বিচার পাচ্ছি না।
শহীদ সায়েম হোসেনের মা শিউলি আক্তার বলেন, আমার ছেলেকে যারা গুলি করে মেরেছে আমি তাদের বিচার চাই। এখনো বিচার হচ্ছে না কেন? সরকার কি করছে? এই বাংলাদেশের মাটিতে খুনি হাসিনার বিচার করতে হবে। আমি আমার ছেলেকে চিকিৎসা করাতে পারিনি, আমি ডাক্তারদের হাতে পায়ে ধরেছি আমার ছেলেটাকে একটু দেখেন, কিন্তু কোনো ডাক্তার আমার ছেলেটাকে দেখেনি।
শহীদ সৈয়দ মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের স্ত্রী দ্রুত বিচার দাবি করে বলেন, যারা এখন ক্ষমতায় আছেন তারা আমাদেরকে নিয়ে অবহেলা করলে চলবে না। তাদেরকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে তারা কাদের বিনিময়ে ক্ষমতায় আছেন। তিনি শহীদ পরিবারের সবাইকে বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
শহীদ ইমনের মা বলেন, যে র্যাব সদস্যের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে সে কীভাবে ভালো পদে চাকরি করে এখনো? এদের নির্দেশদাতা ডিবি হারুন, আয়নাঘরের হারুন কীভাবে পালিয়ে গেল। একশবার না পাঁচ লক্ষ কোটি বার বিচার হওয়া চাই শেখ হাসিনার। তাকে যেন শহীদ মিনারে এ আসমানের নিচে ফাঁসি দেওয়া হয়।
পায়ে গুলিবিদ্ধ ও শরীরে অসংখ্য স্প্রিন্টের আঘাতপ্রাপ্ত আমিরুল ইসলাম ইমন বলেন, পাঁচ মাস হয়ে গেছে আমাদের এখনো পুনর্বাসনের জন্য রাস্তায় নামতে হয়। আমাদেরকে দাবিয়ে রাখার জন্য একটা গ্রুপ এখনো বিভিন্ন জায়গায় সচেষ্ট রয়েছে। আমাদের নামে বরাদ্দ টাকাগুলো ব্যাংকে পড়ে রয়েছে কিন্তু আমার আহত ভাইয়েরা চিকিৎসা পায় না, ঠিকমতো খাবার পায় না, বিভিন্ন মেডিকেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ২০ হাজার, ২২ হাজার আহত, সেখানে এখনো পর্যন্ত ষোলশ মানুষ চিকিৎসার টাকা পেয়েছে। এখনো অনেকে এক লাখ টাকাও পায়নি।
তিনি আরও বলেন, আমরা যাদের কাছে বিচারের জন্য যাব তাদের আশপাশে আওয়ামী লীগ ঘুরঘুর করছে।
একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপারা যাত্রাবাড়ীর শহীদ মোহাম্মদ মেহেদী হাসানের মা মোসাম্মৎ পারভীন। তিনি বলেন, আমার ছেলে তার রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ খুনি হাসিনার ফাঁসিই নয়, আওয়ামী লীগের যত নেতা আছে তাদের এই বাংলার মাটিতে পারায়ে পারায়ে মারেন। এই খুনি হাসিনাকে আপনারা যদি দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেন ওরে জুতার মালা গলায় দিয়ে পারায়ে পারায়ে মারবেন, ফাঁসি পরে। তাকে আমরা শহীদ ও আহতদের মায়েরাই মারব।
শহীদ রানা তালুকদারের মা বলেন, আমি শুধু জামায়াতে ইসলাম থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি আর কোনো টাকা পাইনি। আমি কষ্ট করে মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে ছেলেদের মানুষ করেছি। যখন সুখের মুখ দেখেছি তখনই আমার ছেলে শহীদ হয়ে গেছে।
শহীদ বিলালের বাবা বলেন, ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এই স্বাধীন বাংলাদেশটাকে ডাইনি হাসিনা অশান্তির বাংলাদেশ বানিয়ে রেখেছিল। এই অশান্তির বাংলাদেশটা আবার শান্ত করতে গিয়ে আজকে আমাদের সন্তানরা বিদায় হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে আবার যারা অশান্তির বাংলাদেশ বানানোর চেষ্টা করছে আমরা শহীদদের বাবারা বেঁচে থাকতে সেটা করতে দেব না।
শাপলা চত্বর ম্যাসাকারে শহীদ আনোয়ার হোসেনের বয়োবৃদ্ধ পিতা তার সন্তানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করেন এবং তার সন্তানসহ সব আন্দোলনে শহীদদের জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করেন।
শহীদ পরিবারের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন শহীদ আবুল হোসেনের বড় ভাই আবুল বাশার অনিক, শহীদ মো. রনির বাবা মো. হারুনসহ প্রায় ১৫ জন শহীদ পরিবারের সদস্য এবং আহত অনেকে।
এছাড়াও জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সাংগঠনিক প্রধান মো. শফিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান, ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা মো. সেলিম, অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট কোয়ালিশনের সাধারণ সম্পাদক এস এম তানিম ও জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রোটারিয়ান রাবেয়া আক্তার।
এসএসএইচ