ভেঙে দেওয়া হলো বিকল্পধারার কমিটি, সুর পাল্টালেন মাহি বি চৌধুরী
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জোটবদ্ধ নির্বাচন করতে বিএনপির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছিল অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যোগ দেওয়ার কথা ছিল বিকল্পধারার।
ওই সময় আলোচনার একটা পর্যায়ে এসে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে হবে এবং নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ১৫০ আসন ছাড় দিতে হবে– বিএনপিকে এমন শর্ত দেন বিকল্পধারার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী। সেসময় বিএনপি এই শর্তগুলো মেনে নিতে পারেনি, যার ফলে বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন হয়।
ওই সময় সংবাদ মাধ্যমগুলোকে মাহি বি চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করব না, বিএনপির সাথে নো অ্যান্ড নেভার।
সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আরও বলা হয়, মাহি বি চৌধুরী বিএনপির কাছে এককভাবে ১৫০ আসন ছাড় চাওয়ায় বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে ড. কামাল হোসেনে নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন হয়েছে।
এসব শর্তের কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হতে না পেরে বি চৌধুরী তৎকালীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি–ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপির একটি অংশসহ ১১ দলকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামের আরেকটি রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করেন। এই জোট ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়।
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হন মাহি বি চৌধুরী। একইভাবে ওই নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকে নৌকা মার্কা নিয়ে জয়ী হন দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান।
আরও পড়ুন
৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আগে ছেলে মাহি বি চৌধুরীর এক নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিয়ে বাবা বি চৌধুরী বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় মাহিকে খুব স্নেহ করেন। তার হাতে নৌকা তুলে দিয়েছেন, আমরা আনন্দিত হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর নৌকার সম্মান রক্ষা করতে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
১১টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা হয় শুধু বিকল্পধারা বাংলাদেশের দুই নেতা মাহি বি চৌধুরী ও মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানের। এতে জোটের অন্য শরিকরা ক্ষুব্ধ ও মনঃক্ষুণ্ন হয়। পরে এই জোট ভেঙে যায়।
ওই সময় জোটের শরিক জাতীয় জনতা পার্টির সভাপতি শেখ আসাদ এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘যেদিন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বিকল্পধারা শুধু নিজেদের জন্য দুটি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেছে, যুক্তফ্রন্ট সেদিনই শেষ হয়ে গেছে।’
সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিল বিকল্পধারা। কিন্তু নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার জোটগত নির্বাচন না করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। যদিও এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন।
তবে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে মাহি বি চৌধুরীর ও মেজর (অব.) মান্নানের ভাগ্যে জুটেনি নৌকা প্রতীক। যার ফলে নিজ দলের প্রতীকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারান মাহি বি চৌধুরী।
নির্বাচনে জামানত হারিয়ে অনেকটা রাজনীতি থেকে আড়ালে চলে যান মাহি বি চৌধুরী। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে সুর পাল্টান তিনি।
২১ সেপ্টেম্বর দলের এক সভায় মাহি বি চৌধুরী বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলের অস্তিত্ব রক্ষায় মহাজোটের শরিক হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো ন্যায়সংগত কারণ হতে পারে না। কোনো দল তার আদর্শ বিসর্জন দেওয়ার মধ্যে দলের অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি হয়।
ওইদিন বারিধারা ক্লাবে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত দলের নির্বাহী কমিটির সভায় বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাহী কমিটিসহ জেলা, উপজেলা, মহানগর এবং অন্যান্য কমিটি বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
দলটির দপ্তর সম্পাদক মো. ওসাসিমুল ইসলাম পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভার সভাপতি বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান মাহি বি চৌধুরীর উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করেন। পরে প্রস্তাবটি ভোটে দিলে সর্বসম্মতিতে তা সভায় পাস হয়।
সভায় মাহি বি চৌধুরী বলেন, বিকল্পধারা হবে সিঙ্গেল ইউনিট পার্টি। দলের কোনো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, বিকল্পধারার যেসব নেতাকর্মী ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যুক্তিসংগত কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন তাদের ভুলের জন্য কোনো অনুশোচনা ও উপলব্ধি নেই। সংকট মোকাবিলায় সহজ ও সাধারণ পথে এগোনোর কোনো সুযোগ নেই।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভেতরে যে গণআকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে সেই আলোকে বিকল্পধারাকে নতুন করে শূন্য থেকে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন মাহি বি চৌধুরী।
সভায় নির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত করা হলে সর্বসম্মতিতে একটি জাতীয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কমিটির আকার হতে পারে ৫১ থেকে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট।
কমিটিতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী দলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান কার্যকরী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আর থাকবে একটি প্রেসিডিয়াম, একজন কোষাধ্যক্ষ, একজন দপ্তর সম্পাদক আর সবাই সদস্য থাকবেন।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বিরোধিতা করে সভায় মাহি বি চৌধুরী বলেন, বিকল্পধারার কোনো কমিটিতে একই পরিবারের একাধিক সদস্য থাকতে পারবে না।
এ কারণে মাহি বি চৌধুরী নতুন গঠিত জাতীয় কমিটিতে সদস্য থাকবেন না। দলের প্রাথমিক সদস্য থেকে দলকে সহযোগিতা করবেন।
সভার সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বলেন, ২০১৮ সালে মহাজোটের অংশ হিসেবে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া আমাদের ভুল ছিল। আমাদের নতুন বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। বিকল্পধারার সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিকল্পধারার আদর্শকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জনগণের বিশ্বাস অর্জন করে রাষ্ট্র পরিচালনায় অবদান রাখতে হবে।
সভায় আরও বক্তব্য দেন সহ-সভাপতি মুহাম্মদ মহসিন চৌধুরী, ওবায়দুর রহমান মৃধা, যুগ্ম-মহাসচিব মো. এনায়েত কবির, দপ্তর সম্পাদক মো. ওয়াসিমুল ইসলাম প্রমুখ।
এএইচআর/এসএসএইচ