জাতিসংঘের অধীনে গত ১৫ বছরের গুমের তদন্ত চায় বিএনপি
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের গুম ঘটনা জাতিসংঘের অধীনে তদন্তের উদ্যোগ নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার (৩০ আগস্ট) নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষ্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে এই সংহতি সভা হয়। এতে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন বিএনপির মহাসচিব। অনুষ্ঠানের শুরুতে গুম হওয়া সদস্যদের স্মরণ করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দীর্ঘকাল রাজনীতিতে আছি। অ্যারেস্ট হওয়া জানতাম, হত্যা করা জানতাম কিন্তু গুম করে দেওয়া এটা আমাদের জানা ছিল না। এই আওয়ামী লীগ তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। আজকে অত্যন্ত ভালো কথা… যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তিনি গুম বিরোধী জাতিসংঘের যে সনদ আছে তাতে সই করেছেন। আমরা জানতাম আগের সরকার এটাতে (জাতিসংঘ সনদে) সই করেনি।
তিনি আরও বলেন, আজকে আরও ভালো লাগছে যে, এই প্রথম বাংলাদেশে এই স্বৈরাচারের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘ থেকে একটি দল এসেছে। এটা প্রাথমিক দল ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফান্ডিং টিম। কিন্তু এদের যে টার্মস অব রেফারেন্স গত দুই মাসে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেটা তারা তদন্ত করবে। আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাতে চাই, যে আপনারা জাতিসংঘের যে মানবাধিকার কমিশন আছে তাদের সাথে কথা বলেন। গত ১৫ বছর ধরে যতগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, হত্যা হয়েছে, গুম হয়েছে প্রত্যেকটির তদন্তের ব্যবস্থা করুন। আপনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) বললে জাতিসংঘ অবশ্যই এটা করবে।
ফখরুল বলেন, ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যাকাণ্ড, গুম ঘটনা হয়েছে তার তদন্ত এই জাতিসংঘের কমিটি দিয়ে করতে হবে এবং তার ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে।
আরও পড়ুন
‘গুমের শিকার পরিবারকে রাষ্ট্র থেকে ভাতা দিতে হবে’
গুমের ঘটনায় ব্যক্তিদের সন্ধানে সরকারের তদন্ত কমিশন গঠনের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, একটা কমিশন গঠন করেছেন। এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু একই সঙ্গে আজকে আমি আহ্বান জানাতে চাই এই সরকারকে যে আপনারা প্রত্যেকটি গুম হওয়া পরিবারকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা জানি এখানে অনেক পরিবার আছে যারা অনেক কষ্ট করে তাদের পরিবার চালাচ্ছে, ছেলে-মেয়েদেরকে মানুষ করছে, স্কুল-কলেজে পড়াচ্ছে… এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই পরিবারগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানো। গণতন্ত্র এসেছে… আমরা গণতন্ত্র উপভোগ করব কিন্তু এই গুম হওয়া পরিবারের বাচ্চাগুলো তাদের যে লস হয়েছে, পিতাকে হারিয়েছে তা কোনোদিন ফেরত পাবে না, যে তার স্বামীকে হারিয়েছে সে তা ফেরত পাবে না… তাই এই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এই পরিবারগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ করা।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, যারা গুম ঘটনার সঙ্গে দায়ী আমরা তাদের কমবেশি চিনি। যারা দায়িত্বে ছিলেন, র্যাবের দায়িত্বে ছিলেন, পুলিশের বিশেষ বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে, তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা খুব কষ্ট পাই যখন দেখি রাজনৈতিক নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই সমস্ত ভয়ংকর ব্যক্তি যারা আমাদের হত্যা করেছে, খুন করেছে, গুম করেছে তাদের একজনকেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আশা করি, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার দেখতে পারবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দেখতে পারব। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ যেন একটা জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে তার জন্য আমরা কাজ করতে সক্ষম হব।
‘শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার প্রকল্প গুম’
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য একটা সার্বিক প্রকল্প করেছিলো… গুম তার একটি ছিল। অর্থাৎ গুমের মাধ্যমে ভয়-ভীতি সঞ্চার করে সাধারণ মানুষ যাতে তার স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করতে না পারে সেজন্য এই প্রকল্পে সে নিয়েছিল। সুতরাং এই প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা মূল নায়ক শেখ হাসিনা।
তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পের যারা নেতৃত্বে দিয়েছেন তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে হবে, এই প্রকল্পে যারা সহায়তা দিয়েছে সেই সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে। এই প্রকল্পে যারা জেনে শুনে চোখ বন্ধ করেছিল, যে জেনে না জানার ভান করেছিল, যে দেখে না দেখার ভান করেছিল তাদেরকেও সামনে আনতে হবে। মোট কথায় এই প্রকল্পের সার্বিক সত্যতা জনসমক্ষে আনতে হবে।
‘সর্ষের মধ্যে ভূত’
৬১ দিন গুম থাকার পর ভারতের শিলংয়ে উদ্ধার হওয়ার পর ৯ বছর নির্বাসিত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি আজ খোলাসা করে বলতে চাই, আয়না ঘরের প্রধান খলনায়ক ছিল বেনজীর (বেনজীর আহমেদ) ও জিয়াউল হাসান। একজন চাকুরিচ্যুত হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে। এখানে একজন বলে গেছেন, জিয়াউল হাসানকে কোনো ইন্টারোগেশন করা হচ্ছে না। আমি একমত। তখন কর্নেল ছিল এখন মনে হয় তাকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে রিটায়ার করিয়ে তারপর তাকে গ্রেপ্তার করে নাটক সাজিয়েছে… ডিবিতে নিয়ে গেছে ইন্টারোগেশনের জন্য।
তিনি আরও বলেন, সংবাদপত্রের বন্ধুরা কেউ কি দেখেছেন জিয়াউল হাসান আজ পর্যন্ত কারো গুমে তার ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে। করে নাই। কারণ জিয়াউল হাসানের পেছনে যারা ফ্যাসিবাদকে রক্ষা করার জন্য, হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য যারা কাজ করেছিল তারা এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় আছে।
সালাউদ্দিন বলেন, জিয়াউল হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখন এমনভাবে তাকে ইন্টারোগেশন করা হোক আগামী ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যত গুম-খুন-অপহরণ হয়েছে, তা বলতে যেন সে বাধ্য হয়।
বেনজীর এই গুম-খুনের জন্য একজন মহাখলনায়ক বলে দাবি করে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, হাসিনার দুঃশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য যার ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। সে এখন কোথায়? তাকে খুঁজে বের করতে হবে। পৃথিবীর যেখানেই থাকুক সেখান থেকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে এসে আমাদের কাছে সোপর্দ করতে হবে, বাংলাদেশে তার ন্যায়বিচার করতে হবে। ডিবি হারুন (হারুন অর রশিদ), মনিরুল ইসলাম কোথায়? চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন কোথায়? তাদের গ্রেপ্তার করে, তদন্ত করতে হবে, বিচার করতে হবে। এটা শত শহীদের রক্তের অঙ্গীকার।
শেখ হাসিনা দিল্লী গিয়ে পালিয়ে আছে বলে মন্তব্য করে সালাউদ্দিন বলেন, আমি দাবি করছি দিল্লীর সরকারকে তাকে ফেরত দেন। যদি ফেরত না আনা হয় তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিচার করা হবে। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ বাংলাদেশে বহু গুম-খুনের নায়ক। তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপির মানবাধিকার কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনা, চৌধুরী আলমের মেয়ে খাদিজা আখতার, মায়ের ডাকের সানজীদা ইসলাম তুলিসহ গুম হওয়া পরিবারের কয়েকজন সদস্য বক্তব্য রাখেন।
এএইচআর/এমজে