দলে যেমন রাজনৈতিক পরিবেশ চান নারী রাজনীতিবিদরা
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার পুরুষের চেয়ে বেশি নারী। বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদেও রয়েছেন নারী নেত্রী। তারপরও জাতীয় রাজনীতিতে পিছিয়ে নারীরা। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকা নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায়। এছাড়া সামাজিক-ধর্মীয় ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার কারণে রাজনীতিতে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারছে না বলেও মনে করছে নারী নেত্রীরা।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। আট কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা আট কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার তিনজন।
নারী রাজনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকলে নারীরা রাজনীতিতে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাশাপাশি নারীকে রাজনীতিতে এগিয়ে নিতে হলে পুরুষের পাশাপাশি তাকেও দলের কমিটিতে সাংগঠনিক পদ দিতে হবে। এছাড়া নারী রাজনীতিবিদ যেন দলের অভ্যন্তরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে শিকার না হয় সেটি খেয়াল রাখতে হবে।
নারী নেত্রীরা আরো বলছেন, সামাজিক-ধর্মীয় ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা এবং পেশি শক্তি-অর্থের কারণে রাজনীতিতে নারীর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া উচ্চশিক্ষায় নারীর হার কম হওয়াও রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে নারীদের ‘কোটাবন্দি’ করে রাখা হয়েছে। যার ফলে নারী চাকরি ক্ষেত্রে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে এগিয়ে গেলেও রাজনীতিতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শিরিন আখতার বলেন, শুধু রাজনীতিতে নয়, পরিবার-সমাজ সব ক্ষেত্রে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ দরকার। নারীকে রাজনীতিতে এগিয়ে নিতে হলে, রাজনৈতিক দলের অফিস, গঠনতন্ত্রে নারীকে এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা থাকতে হবে। তাহলে নারীর সঠিক ক্ষমতায় ও যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে। কীভাবে একজন নারী রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে পারে, তার জন্য ট্রেনিং, কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে একজন নারী এমনি-এমনি রাজনীতিতে আসবে, এগিয়ে যাবে— এমনটা ভাবা ঠিক হবে না।
যদি রাজনৈতিক দল বা সংগঠনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকে, তাহলে একজন নারী রাজনীতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বলে মনে করেন শিরিন আখতার। তার মতে, শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে একজন নারী যেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।
নারী রাজনীতি করতে এলে ঘরে-বাইরে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে উল্লেখ করে এই নারী নেত্রী বলেন, একজন নারীকে প্রথমে গৃহস্থালির কাজ শেষ করতে হয়। তারপর তাকে অফিস-আদালত এবং রাজনৈতিক মাঠে যেতে হয়। এই গৃহস্থালির কাজ যদি ভাগ করে নেওয়া যায় তাহলেই নারী এগিয়ে যেতে পারবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে।
ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে আলাদা করে রাখা হয় বলেও উল্লেখ করে শিরিন আখতার। বলেন, যদিও ধর্মে নারীর সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। কিন্তু সেই নারীকে ধর্মীয় রীতি-নীতির কথা বলে ঘরে বন্দি করে রাখার চেষ্টা করা হয়।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য শেরিফা কাদের বলেন, শুধু রাজনীতি নয়, সমাজাকি-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে আমি নারীর যথাযথ মূল্যায়ন চাই। নারী মানেই পুরুষের নিচে থাকবে এমনটা যেন না হয়। নারী-পুরুষ সবাইকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। নারীকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা দিতে হবে। তাহলে সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারী এগিয়ে যেতে পারবে।
আরও পড়ুন
কিছু প্রতিবন্ধবকতা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের রাজনীতি করার পরিবেশ আগের চাইতে ভালো বলে উল্লেখ করেন শেরিফা কাদের। তিনি বলেন, আসলে কিছুই সমস্যা তো আছে, সেটাকে নারী নেত্রীদের উপযুক্ত করে নিতে হয়। আপনি একটা জায়গায় পা ফেলবেন, তার আগে তো আশপাশ দেখে নিতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকলে নারীকে সেটা তার ব্যবহার ও চলাফেরার মাধ্যমে উপযুক্ত করে নিতে হবে। অন্যান্য দলের কথা তো আমি বলতে পারবো না, কিন্তু জাতীয় পার্টিতে নারীদের রাজনীতি করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে।
শেরিফা কাদের আরো বলেন, এখনও আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়ে গেছে। পুরুষ নেতারা নারীদের এগিয়ে যেতে দিতে চায় না, তারা মনে করে নারী নেতৃত্ব দিতে পারবে না। নেতৃত্বের কাজ পুরুষরা করবে। আবার নারীদের পরিবার-সংসারে সময় দিতে হয়।
সুযোগ পেলে নারীরা যে রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তিনি নারী। তার আগে যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনিও নারী। তারপরও আমাদের সমাজে, রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না বলে মনে করেন শেরিফা কাদের।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুন রায় চৌধুরী বলেন, একটি রাজনৈতিক দলে নারীকে নারী হিসেবে নয়, তার কর্মকে মূল্যায়ন করা হোক। অনেক সময় আমাদের পরুষতান্ত্রিক সমাজ সেটা করতে চায় না। সেটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হোক কিংবা সমাজ ব্যবস্থায় হোক। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি নারী থেকে পারিবারিক শিক্ষা পেয়ে একজন পুরুষ রাষ্ট্রের বড়-বড় ভূমিকা পালন করছে। ফলে, একজন নারী সংসার থেকে-রাষ্ট্র পরিচালনা সবক্ষেত্রে তার ভূমিকা আছে। যেটা অনেক ক্ষেত্রে একজন পুরুষ পারে না।
তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোতে একজন পুরুষদের পাশাপাশি একজন নারীরও সাংগঠনিক পোস্ট থাকা উচিত। তাহলে নারী সঠিক ক্ষমতায়ন হবে। তারাও সমানতালে এগিয়ে যেতে পারবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মারুফা আক্তার পপি বলেন, আমাদের দেশে পরিবারে পুরুষদের তুলনায় নারী বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা শিকার হয়। সেক্ষেত্রে পুরুষ যতটা সহজে রাজনীতি করতে পারে, নারীর জন্য সেটা ততটা সহজ হয় না। কারণ আমাদের সমাজ নারী রাজনীতি করুক সেটা সহজে মেনে নিতে পারে না।
তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী রাজনীতি অনেকটা সহজ করে দিয়েছেন। তারপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কিছু সমস্যা তো রয়ে গেছে। তবে, আগামীতে নারী যেন পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে রাজনীতি করে যেতে পারে, সেই ক্ষেত্রটা তৈরি করে যেতে চাই প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব।
সমাজকর্মী খুশি কবিরের মতে, আসলে নারীকে ব্যবহার করা হয় কর্মী হিসেবে। আপনি দেখবেন রাজনৈতিক দলের তৃণমূলে নারীরাই বেশি কাজ করে। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ নারীকে কম দেওয়া দলগুলোতে।
মূলত রাজনীতি ও নির্বাচনে নারীদের সামনে তিনটা বিষয় বাধা হিসেবে দাঁড়ায় বলে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, একটা হলো দলগুলোর সদিচ্ছার অভাব, দুই হলো নারীকে সমানভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা না থাকা। তৃতীয় হচ্ছে- পেশি শক্তি, অর্থ এবং সহিংস পরিবেশ।
উচ্চশিক্ষা নারী অংশগ্রহণ কম ও ধর্মীয় পশ্চাৎপদ প্রথা রাজনীতিতে নারী এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় বলে মনে করেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বলেন, ধর্মীয়-সামাজিক পশ্চাৎপদ প্রথার কারণে মেয়ের সাহস নিয়ে রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে চায় না। ফলে ব্যাপক মাত্রায় রাজনীতি ও নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ কম।
তিনি আরো বলেন, দেশে এখনও ধর্মীয়-সামাজিক বাধাগুলো বিদ্যমান রয়েছে। বলা হয়, মেয়েরা থাকবে পর্দার ভেতরে। পারিবারিক বাধা হচ্ছে- নারীরা বাড়িতে কাজ করবে তারা রাজনীতি কেন করবে? আবার দেখা যায় ইউনিয়ন পরিষদে নারী নির্বাচিত হলেও পুরুষ সহকর্মীরা তাকে জায়গা দিচ্ছে না, বরাদ্দ কম দিচ্ছে। অনেক সময় নিপীড়নও করে। এখানে চলে পেশীশক্তির ব্যবহার।
এএইচআর/এসএম