কার অধীনে যাচ্ছে সাত কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত সরকারি সাতটি কলেজ ছাত্রলীগের দায়িত্ব নিতে চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে এমন কানাঘুষা চলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও বক্তব্যের জেরে বিষয়টি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হয়ে গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
মূলত, দীর্ঘদিন ধরে ঢাবি অধিভুক্ত ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও সরকারি বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির হাত ধরে। কমিটি দেওয়া, সাংগঠনিক তদারকিসহ যাবতীয় নির্দেশনা কেন্দ্রীয় কমিটি দিচ্ছে।
সম্প্রতি সাতটি কলেজের ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ চাইছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। তারা দাবি করছে, সাতটি কলেজের ছাত্রলীগের দায়িত্ব ঢাবি ছাত্রলীগকে দেওয়া হলে একাডেমিক মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক মানেরও উন্নয়ন ঘটবে। তবে, এতে মোটেও সম্মতি নেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের।
জানা গেছে, গত ১৭ জুলাই (সোমবার) হঠাৎ ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। ওই দিনই লোকমুখে চাউর হয় পটপরিবর্তনের এমন ইচ্ছা। ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই (মঙ্গলবার) রাতে ঢাকা কলেজ শাখার সাংগঠনিক কার্যক্রম বাড়ানোর কথা জানিয়ে কমিটি দেওয়ার লক্ষ্যে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ। সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে সাত দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয় জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার জন্য। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটিতে পদপ্রত্যাশী প্রায় ৪৮২ নেতাকর্মী সিভি জমা দেন। তবে, আগস্ট পেরিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় চলে এলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এদিকে, গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সংকট নিরসনে ঢাবি ছাত্রলীগের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ঢাবি ছাত্রলীগের সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, অধিভুক্ত সাত কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে হওয়ার সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কমিটি দেবে। উপজেলায় উপজেলায় কর্মীদের সুসংগঠিত করবে। আমরা ঢাবি ছাত্রলীগ ঢাবি বিশ্ববিদ্যালয়কে সুসংগঠিত করব। অধিভুক্ত সাত কলেজকে সুসংগঠিত করব।
তার এমন মন্তব্যের জেরে রাতেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ। এ সময় কেন্দ্রীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকার ইচ্ছার কথা জানিয়ে ‘সেন্ট্রালেই আছি, সেন্ট্রালেই থাকব’, ‘ঢাবির সিদ্ধান্ত মানি না, মানব না’, ‘অবৈধ সিদ্ধান্ত মানি না, মানব না’, ‘ঢাবির অধীনে যাব না, যাব না’, ‘শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত, চূড়ান্ত চূড়ান্ত’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানান অন্যান্য কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ঢাবি ছাত্রলীগের এমন সিদ্ধান্ত ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ উল্লেখ করে অনেকে স্ট্যাটাসও দেন।
যা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক
সাত কলেজের ছাত্রলীগের দায়িত্বে কে থাকবে— এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত।
সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে ঢাবি ছাত্রলীগের অবস্থান জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করে বিষয়টি জানাবেন।’
কোন প্রক্রিয়ায় সাত কলেজের ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ঢাকা কলেজে গিয়েছিলাম। তখন আমরা শিক্ষার্থীদের মনোভাব জানার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে পার্টির হাই কমান্ড যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেয়, আমার জানা মতে ঢাকা কলেজসহ অন্য কোনো কলেজের কারোরই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।’
ঢাবি ছাত্রলীগের অধীনে কলেজগুলো আসলে সংগঠনের ভিত আরও মজবুত ও পাকাপোক্ত হবে বলেও জানান তিনি।
‘এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত’— উল্লেখ করে সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘সাত কলেজের ছাত্রলীগের দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অধীনে দেওয়ার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসেনি। অনেক আগে থেকেই দলের হাই কমান্ডকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বলা হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও জানানো হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টি নেত্রীর টেবিলে আছে। নেত্রীই সিদ্ধান্ত দেবেন। এখানে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত দেওয়ার কিছু নেই। আবার নিজ নিজ অনুসারীদের দিয়ে মিছিল-মিটিং করিয়েও সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। ঘোলাটে অবস্থা তৈরি করেও সম্ভব নয়।’
বিষয়টির যৌক্তিকতা কতটুকু— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ ছাত্রলীগকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের অধীন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আওতায় আনার বিষয়টি আগে কখনও সামনে আসেনি। এত দিন এর প্রয়োজনও ছিল না। কারণ, এর আগে সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল না। ২০১৭ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একটি স্বপ্ন নিয়ে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করেন। তিনি চেয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার মান যেন সমান হয়। সাত কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম, পরীক্ষা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হয়।’
‘ঢাবির একাডেমিক কালচার যদি সাত কলেজে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে রাজনৈতিক কালচারেও সমান সুযোগ প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যের রাজনৈতিক কালচার রয়েছে সেটি যদি সাত কলেজে তৈরি করা যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একাডেমিক কালচারও স্থাপন করা যাবে।’
‘এর আগে সাত কলেজ নগরের আওতাভুক্ত ছিল। পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে কাজ করে তারা। এখন যেহেতু সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত, তাই এর কমিটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ দেবে। এ প্রস্তাবনা আমরা রেখেছি’— বলেন তানভীর হাসান সৈকত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অধীনে যাওয়ার বিষয়টি সামনে আসার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা কলেজ ও বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে হয়নি। কেউ কেউ তাদের দিয়ে করিয়েছেন। আমরাও আমাদের অনুসারীদের দিয়ে করাতে পারি। কিন্তু এতে তো শৃঙ্খলা থাকে না।’
এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে কেউ কেউ নিজেদের দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘একটি কথা বললেই সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়ে যায় না। এসব কাজ তো তাদের দুর্বলতার প্রমাণ। এখন আমরা যদি আমাদের অনুসারীদের দিয়ে কিছু করাই, তাহলে আবার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে। আমরা তো সেই কাজ করব না। আমরা এ নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছি। সেখানে তো সাত কলেজের হাজারের ওপর শিক্ষার্থীর সরব উপস্থিতি ছিল।’
ঢাবির একাডেমিক কালচার যদি সাত কলেজে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে রাজনৈতিক কালচারেও সমান সুযোগ প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যের রাজনৈতিক কালচার রয়েছে সেটি যদি সাত কলেজে তৈরি করা যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একাডেমিক কালচারও স্থাপন করা যাবে
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে ঢাবি ছাত্রলীগের টানাপোড়েন চলছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টানাপোড়েন চলছে, বিষয়টি এরকম নয়। আসল বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব ও কর্মপরিধি এক রকম, আমাদের দায়িত্ব ও কর্মপরিধি আরেক রকম। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ হিসেবে তারা ৬৪ জেলায় তাদের কমিটি দেবে। ৬৪ জেলার তৃণমূলকে সুসংগঠিত করবে, সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করবে এবং সামনের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবে। এগুলো তাদের দায়িত্ব।’
‘এখন কেউ যদি সেগুলো না করে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়ে থাকে— এটি তো ঠিক নয়। আমরা আমাদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছি, তারা তাদের মতো করছে; এতটুকুই। এর বাইরে অন্য কিছু নয়।’
বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে আছি। চেষ্টা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সুশৃঙ্খল করার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ছাত্রবান্ধব করার। পাশাপাশি অধিভুক্ত সাত কলেজের একাডেমিক বিভিন্ন বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা তৈরি এবং অসুবিধা নিরসনে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটি সাংগঠনিক বিষয়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাজ হবে। গঠনতন্ত্র ছাত্রলীগের সব নেতাকর্মীর কাছে সংবিধান। গঠনতন্ত্রে যেভাবে ছাত্রলীগের ইউনিটসমূহের কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, সেভাবেই কাজ হবে।’
আরএইচটি/এমএআর