সংঘর্ষ-ভাঙচুর, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার হরতাল
বিক্ষোভ মিছিল, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। রোববার (২৮ মার্চ) দিনব্যাপী হরতাল পালন করে ইসলামপন্থী সংগঠনটি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে শুক্রবার (২৬ মার্চ) বায়তুল মোকাররম, হাটহাজারী মাদরাসা এলাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ এবং সরকার দলীয় বিভিন্ন সংগঠনের হামলা ও সংঘর্ষের প্রতিবাদে এ হরতালের ডাকা দেয় সংগঠনটি। একই ঘটনায় শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য দেশব্যাপী পালিত এ হরতালের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
রাজধানী
দিনের শুরুতে রাজধানীতে ঢিলেঢালাভাবেই শুরু হয় হেফাজতের এ হরতাল। সকাল ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর কোথাও কোনো পিকেটিংয়ের কিংবা মিছিলের খবর পাওয়া যায়নি। হরতাল প্রতিরোধ ও যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সতর্ক অবস্থানেই ছিল পুলিশ।
তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরব উপস্থিতি দেখা যায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের। হরতালের সমর্থনে ১০টা ২০ মিনিটের দিকে রাজধানীর পল্টন এলাকায় মিছিল করেছে হেফাজতে ইসলাম। এতে সংগঠনটির কয়েকশ কর্মী অংশ নেন। মিছিলে হেফাজতের সমর্থকরা নানা রকম স্লোগান দেন।
বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর পল্টনে হেফাজতে ইসলাম ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উভয়পক্ষকেই ইট-পাটকেল ছুড়তে দেখা যায়। একপর্যায়ে হেফাজত সমর্থকদের ধাওয়া খেয়ে গুলিস্তানের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে চলে যান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ পাল্টা ধাওয়া দিলে হেফাজত সমর্থকরা পিছু হটে পল্টনের দিকে চলে যান।
জোহরের নামাজের পর ফের পল্টন মোড়ে অবস্থান নেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। সেখানে তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থানের পর বিকেল ৩টার পর তারা মিছিলটি নিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দিকে চলে যান। এতে পল্টন এলাকায় যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।
হরতালের সমর্থনে বিকেল ৩টার পর রাজধানীর কুড়িল-বাড্ডা-রামপুরা-গুলিস্তান সড়ক অবরোধ করে রাখে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। এতে সড়কে যানচলাচল বন্ধ থাকে। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
হরতালে কারণে আজকে সড়কে যানবাহন তুলনামূলক কমই ছিল। সকাল থেকেই নীলক্ষেত, আজিমপুর, উত্তরা ও বিমানবন্দর যানচলাচল স্বাভাবিক ছিল। সকাল ১০টার দিকে পুরান ঢাকা এলাকায় যানজটেরও সৃষ্টি হয়। তবে পল্টন সারাদিনই যানচলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। বিকালে সড়ক হরতালের সমর্থনকারীরা প্রগতি সরণী বন্ধ করে বাড্ডা, রামপুরায় যানচলাচল ব্যাহত হয়। এছাড়া সদরঘাট থেকে স্বাভাবিকভাবেই ছেড়ে গেছে লঞ্চ। তবে যাত্রী কম ছিল বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সারাদেশের চিত্র
>> হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে মাইকে ঘোষণা দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছেন হেফাজতের কর্মীরা। এতে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর এবং দুটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের দিকে এ ঘটনা ঘটে।
>> হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে উত্তাল হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও এরপর থেকে হেফাজতের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্ররা জেলা শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এসব ঘটনায় দুই সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।
>> হরতালের সমর্থনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সকাল ১০টা থেকে পটিয়া উপজেলার খরনা এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন হেফাজতের কর্মীরা। এতে সাড়ে ১০টা থেকে মহাসড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে বলে জানান চট্টগ্রাম পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পটিয়া সার্কেল) তারিক রহমান। বিকেল ৪টার দিকে এ সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।
>> হরতালের সমর্থনে নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সকাল ৭টা থেকে মহাসড়কের জেলখানার মোড় এলাকায় অবস্থান নেন তারা। পরে তারা সেখান থেকে চলে গেলে সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।
>> ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মৌচাক এলাকায় রোববার সকাল থেকে কাফনের কাপড় পরে সড়ক অবরোধ করে হরতাল পালন করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা।
>> সকাল-সন্ধ্যা এ হরতালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল এলাকা পর্যন্ত তাণ্ডব চালিয়েছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। রোববার বেলা ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত দফায় দফায় হেফাজতের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
>> দুপুর ১টার দিকে কিশোরগঞ্জে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় হরতালের সমর্থনে হেফাজতের নেতাকর্মীরা কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছেন। সেখানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে হেফাজতের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষও বাধে।
>> ফরিদপুরে ভাঙ্গায় একদল সংঘবদ্ধ জনতা থানায় আক্রমণ করেছে। তাদের হামলায় ছয় পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে থানার ফটক। এ সময় পুলিশের দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে। পরে পুলিশ ৪৫টি শর্টগানের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
>> ময়মনসিংহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালিত হলেও আন্দোলনকারীদের কঠোর অবস্থান লক্ষ্য করা যায় চরপাড়ায়। রোববার সকাল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে এ এলাকায় জমা হন আন্দোলনকারীরা। পরে তারা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে ও বাঁশ ফেলে যানবাহন আটকে দেন।
>> সুনামগঞ্জে ভোর থেকে লাঠি হাতে সড়কে অবস্থান নেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। সড়কে কোনো ধরনের যান চলাচল করতে দেননি তারা। এতে বিপাকে পড়েন দূরপাল্লার যাত্রীরা।
>> মৌলভীবাজার-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে কুলাউড়া উপজেলার পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে সড়ক অবরোধ করে রেখে হরতাল সমর্থকরা সেখানে জোহরের নামাজ আদায় করেন।
>> আন্তঃনগর সোনারবাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনে হেফাজতের নেতাকর্মীদের ইট-পাটকেল ছোড়ার ঘটনায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে। রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাময়িক ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন আটকা পড়েছে।
>> হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে বিভাগীয় শহর রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্কাবস্থানে ছিল। রংপুর জেলার প্রবেশদ্বারসহ নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েন ছিল। স্বাভাবিক ছিল সড়ক, মহাসড়কে যানবাহন চলাচল।
হরতাল প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের অবস্থান
>> হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাজধানীতে সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সকাল থেকেই রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে হরতালের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা হরতালবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করেন।
>> হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
>> ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। দুপুরে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী নিয়ে মিছিল বের করেন তিনি।
আর বাড়ছে না হরতাল
হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল বাড়ানো হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী। রোববার (২৮ মার্চ) পল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
হেফাজতে মহাসচিব বলেন, সোমবার (২৯ মার্চ) দোয়া মাহফিল ও শুক্রবার (২ এপ্রিল) বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে।
নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, হেফাজতে ইসলাম মোদির আগমন প্রত্যাহার করার জন্য কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু মোদির আগমনের দিন হেফাজতের কোনো কর্মসূচি ছিল না।
উল্লেখ্য, গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে হেফাজতের বিক্ষোভ মিছিলে হামলার ঘটনায় চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করে। সেখানে পুলিশের গুলিতে চার জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় উত্তাপ ছড়িয়ে পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও। সেখানে সংঘর্ষে নিহত হয় এক জন। এসব ঘটনার জেরে শনিবার (২৭ মার্চ) বিক্ষোভ ও রোববার (২৮ মার্চ) হরতালের ডাক দেয় হেফাজত।
এর আগে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালন করে বিএনপি। সেই হিসেবে এক বছর এক মাস ২৬ দিন (প্রায় ১৪ মাস) পর দেশে আবারও হরতাল পালন হলো।
হরতাল শেষে নারায়ণগঞ্জে গাড়িতে ফের আগুন
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে হরতালের সমর্থনে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয় জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। একই সঙ্গে ১৫টি গাড়িতে আগুন দিয়েছেন হরতাল-সমর্থকরা।
হেফাজতে ইসলামের ডাকা রোববার (২৮ মার্চ) সকাল-সন্ধ্যা হরতালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর পর্যন্ত এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে।
রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সাইনবোর্ড এলাকায় কয়েক দফায় পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা হরতাল পালনকারী হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এ সময় উভয়পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হলে ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ ২০ জন আহত হন।
এমন ঘটনার পর বিকেলে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় কয়েকটি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। এসব গাড়িতে কারা আগুন দিয়েছে তা জানা যায়নি।
এফআর