সিটি নির্বাচনেও ‘ঘুম হারাম’ আওয়ামী লীগের
• দলীয় কোন্দল নিরসনে কাজ করবে বিশেষ টিম
• গাজীপুর, বরিশাল ও সিলেট নিয়ে যত চিন্তা
• জাহাঙ্গীরের ওপর ক্ষুব্ধ আওয়ামী নেতৃত্ব
• গাজীপুরে কাজ করবে ২৮ সদস্যের সমন্বয় টিম
আসন্ন পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়েছেন ক্ষমতাসীনরা। দলের কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ গোপনে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও নির্বাচনে দায়িত্বশীলদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে।
এর আগে কয়েকটি সিটি নির্বাচনে দলীয় কোন্দলের কারণে সিলেট ও কুমিল্লায় নৌকার প্রার্থী হেরেছিলেন বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেই চিন্তায় এখনই ‘ঘুম হারাম’ তাদের। তবে, দলীয় কোন্দল নিরসনে কাজ করছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। এরই মধ্যে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য ২৮ সদস্যের সমন্বয় টিম গঠন করা হয়েছে। সিটি নির্বাচনে বরিশাল ও সিলেটের তুলনায় এবার গাজীপুরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২৫ মে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
রাজশাহীতে বর্তমান মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জমান লিটন, খুলনায় বর্তমান মেয়র তালুকদার আবদুল খালেককে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গাজীপুরে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বর্তমান মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে বাদ দিয়ে টঙ্গী পৌরসভার সাবেক মেয়র আজমত উল্লাহ খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বরিশালে চাচা-ভাতিজার মনোনয়ন লড়াইয়ে দলের সমর্থন পেয়েছেন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবার মনোনয়ন পাননি। সিলেটে এবার প্রার্থী করা হয়েছে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে খুব একটা পরিচিত মুখ নন। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। করোনা মহামারির সময় সিলেট সিটির সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহম্মেদ কামরান মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন সিলেট সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ছিলেন।
আরও পড়ুন : মনোনয়ন বঞ্চিতরাও এখন মাঠে
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনকে ওইভাবে কখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই না। নির্বাচনে জয় লাভের টার্গেট নিয়ে আমরা বিজয়ী হতে চাই। জয় লাভই আমাদের লক্ষ্য থাকে। অতীতের মতো এবারও আমরা সব জায়গায় যেটা দেখতে চাই, সেটা হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। যে নির্বাচনে জনগণ নির্ভয়ে ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দেবে। ভোটারদের ভোট প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ী হতে চাই। আমাদের লক্ষ্য ও ভরসার জায়গা হচ্ছে জনমত ও জনগণের প্রত্যাশা।’
‘নির্বাচন ভন্ডুল, বানচাল ও বিতর্কিত যারা করতে চায়, প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের হাত থেকে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, গণতন্ত্রের সাংবিধানিক মর্যাদা সমুন্নত রাখা আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে সবসময় নিয়ে থাকি। এর বিপক্ষে যারা, তাদের বিপক্ষে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যেকোনো মূল্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, চেতনা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করি। এখানে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের প্রতিহত করা আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি।’
আরও পড়ুন : ‘ছাত্রলীগকে বিনয়ী হয়ে ভোট চাইতে হবে’
দলীয় সূত্র মতে, গাজীপুর, সিলেট ও বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে এবার বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে আওয়ামী লীগ। এ তিন সিটিতে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী বা অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। প্রকাশ্যেই অনেকে নৌকার বিরোধিতা করছেন। আবার বিদ্রোহীরাও শক্ত অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, খুলনা ও রাজশাহীতে দলীয় প্রার্থীরা সহজেই বিজয়ী হবেন বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা।
গাজীপুর সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও তার মা। শেষমেষ বাছাই পর্বে ঋণখেলাপির দায়ে জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বৈধ হয়ে যায় তার মায়ের মনোনয়ন। নিজের মনোনয়ন টিকতে নাও পারে, সেটা আগে থেকে আঁচ করতে পেরে মায়ের নামে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন সাবেক এ মেয়র।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, রাজধানীর পাশের শহর হচ্ছে গাজীপুর। এ সিটিতে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র থাকাটা জরুরি। তাই সেখানে ত্যাগী নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বঞ্চিত করা হয় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরকে। মনোনয়ন না পেয়ে জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে অবস্থান নেন। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল গাজীপুরে এখন স্পষ্ট। ফলে এ নির্বাচনের বৈতরণি পার হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
আরও পড়ুন : ‘বাতিলদের’ তালিকা হচ্ছে, যোগ্য প্রার্থী খুঁজতে মাঠে গোয়েন্দারা
অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল এবং তার মায়ের মনোনয়ন বৈধ করাতেও রাজনীতি দেখছেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর। দলীয় নেতাদের ধারণা, জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনে না থাকলে তার কর্মী-সমর্থকরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে চাইবে না।
প্রায় একই চিত্র বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও। মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করায় বরিশালে সাদিক আবদুল্লাহকে ঘিরে একটি বলয় তৈরি হয়েছে। ওই বলয়কে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করানো দুরূহ ব্যাপার। তবে, নৌকার পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র। অন্যদিকে, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়েও এবার অন্যরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দলের যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তা শেষ পর্যন্ত থাকে না। এটা আওয়ামী লীগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তবে, অন্যভাবে কেউ কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার; শেষ পর্যন্ত টিকবে না।’
আরও পড়ুন : গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আ.লীগের সমন্বক যারা
জানা গেছে, সিলেটে আওয়ামী লীগকে জিততে হলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ মিটিয়ে দলকে আনোয়ারুজ্জামানের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এ সিটির সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচন করবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে, এখানে আওয়ামী লীগের বিপরীতে অন্য যেকোনো প্রার্থী চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন। কারণ, এখানে বিরোধী ভোট এবং আওয়ামী লীগের একাংশের ভোটও যুক্ত হবে নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাক্সে।
যেহেতু নির্বাচনের আগে আরও সময় আছে, সেহেতু কিছুটা ধীরগতিতে বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নিয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে চায় আওয়ামী লীগ। তার আগে দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা দুই সিটিতে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেবেন।
দলীয় সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে রাষ্ট্রীয় সফরে দেশের বাইরে আছেন। দেশে ফেরার পর দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিশেষ বৈঠক করবেন তিনি। পাঁচ সিটি এলাকার সাংগঠনিক অবস্থা তাদের কাছ থেকে জানবেন। ওই বৈঠকে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন। তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলোও ওই বৈঠকে মূল্যায়ন করা হবে।
আরও পড়ুন : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন : দলীয় কৌশলে ‘কূটকচাল’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জীবনের পরতে পরতে চ্যালেঞ্জ আছে। নির্বাচন মানেই একটা চ্যালেঞ্জ। সেখানে জনগণের রায় পক্ষে আনা, নির্বাচিত হওয়া— বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়। জনগণকে সুসংগঠিত করতে হয়। ভোটারদের সন্তুষ্ট করে পক্ষে নিয়ে আসতে হয়। আশা করি, এ চ্যালেঞ্জে আমরা জয়ী হব।’
এদিকে, গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে ২৮ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের টিম। টিম লিডার করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে। সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। টিমের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপিকে।
অপর ২৫ নেতাকে টিমের সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। তারা হলেন– আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সিমিন হোসেন রিমি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস. এম কামাল হোসেন, আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক জাহানারা বেগম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামসুন নাহার, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত, তারানা হালিম, সানজিদা খানম, আনোয়ার হোসেন, সাহাবুদ্দিন ফরাজী, ইকবাল হোসেন অপু, মোহাম্মদ সাইদ খোকন, রেমন্ড আরেং ও নির্মল কুমার চ্যাটার্জি।
এমএসআই/এসএসএইচ/