মন্ত্রীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যে ‘ফুঁসছে’ আওয়ামী লীগ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত হয় নতুন মন্ত্রিসভা। ছিটকে পড়েন অতীত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অধিকাংশ নেতা। বয়সে প্রবীণ ও তৃণমূলে দীর্ঘদিন রাজনীতি করাদের ওপরই আস্থা রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে মন্ত্রিসভায় স্থান হয় বিভিন্ন পেশার দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের। তবে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীদের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্যে’ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, ভারতে পাচার বন্ধে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বে চলছে নানামুখি সংকট। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির পর বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। ইউরিয়া সার থেকে শুরু করে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিতে চাপ পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে। ডলারের দাম বাড়ার পাশাপাশি জীবন-যাত্রায় নাভিশ্বাস পরিস্থিতি। এ সময় সবাইকেই দায়িত্বশীল হওয়া দরকার।
গত শুক্রবার (১২ আগস্ট) সিলেটে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ প্যানিক ছড়ানোর জন্য এমন কথা বলছে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্য ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে বিরোধী শিবিরেও। শনিবার (১৩ আগস্ট) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য জনগণের সঙ্গে তামাশা বলে মন্তব্য করেছেন।
রাজধানীতে গত শনিবার একটি আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের আমি বলবো, প্রত্যেককে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে দায়িত্বশীল হতে হবে। এই সময়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনো কথা বলা সমিচীন নয়, এ সময় ক্ষমতার দাপট দেখানো সমিচীন নয়। ঠান্ডা মাথায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করতে হবে, এটাই আজকে আমাদের সবচেয়ে বড় মেসেজ।’
সংকটে নেতাকর্মী ও দায়িত্বশীলদের কথাবার্তায় সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সারা বিশ্বে সংকটে, একটা নেতিবাচক প্রভাব আজকে বাংলাদেশ মোকাবিলা করছে। আমরা জানি অনেক মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট অব লিভিং যেভাবে বেড়ে গেছে, মানুষ কষ্ট করছে এটা ঠিক। কিন্তু সারা দুনিয়ায় যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমাদের সামনে আর কোনো উপায় ছিল না।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সময়টা ভালো যাচ্ছে না। এ নির্মম সত্যটি দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ যতটা বেশি অনুধাবন করবেন তত বেশি মঙ্গল হবে। চারদিকে হতাশজনক খবরাখবর, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিতে এমনিতেই সাধারণ জনগণের মন মেজাজ স্বস্তিকর নয়। এ অবস্থায়, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত জনগণ নিযুক্ত এবং জনগণের ট্যক্সের টাকায় বেতনভাতা প্রাপ্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের লাগামহীন কথাবার্তা জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করতে পারে।
তিনি বলেন, কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আন্তরিকভাবে কাজ করা, ‘ব্যানাহুদার’ মত বেহুদা ভাষণ দেওয়া নয়। বেহুদা ভাষণ সরকারকে বিতর্কিত করে, দুর্বল করে। বিনয়ী ভাষণ জনমনে স্বস্তি ও আস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, সরকার-রাষ্ট্র অধিকতর শক্তিশালী হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমাদের সবার মার্জিত ভাষায় সীমিতভাবে দায়িত্বশীল কথা বলা উচিত। জনমনের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলা উচিত না।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্ত্রী হয়তো নিজের কথা বলেছেন। তবে সবাই কি সেটা মনে করেন? করেন না। আমাদের দলীয় নেতাকর্মী, এমপি-মন্ত্রী সবাইকেই সতর্ক হয়ে কথা বলা উচিত।
এর আগে গত সপ্তাহে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘গ্রাম-গঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেকটি মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামা-কাপড় রয়েছে। গ্রামের প্রায় সব রাস্তাঘাট পাকা হয়ে গেছে। প্রত্যেক গ্রামে প্রাইমারি স্কুল করা হয়েছে, ঘর না থাকলে ঘর করে দেওয়া হচ্ছে।’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত ১০ আগস্ট সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কিছু মানুষ আছে আমাদের পছন্দ করে না। তারা বলছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষ মরে যাবে। তবে আমরা অস্বীকার করব না। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে এটা সত্যি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনো কেউ মারা যায়নি, আশা করি মরবেও না।’
এর আগে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক গত ৭ আগস্ট কুমিল্লায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, ‘এ দেশের কৃষকেরা এত ত্যাগী যে তারা বউয়ের গলার হার, কানের দুল বিক্রি করেও চাষাবাদ করে। তারা গরু-ছাগল বিক্রি করে সার কিনে ফসল উৎপাদন করে।’
তিনি আরও বলেন, উৎপাদনের ওপর জ্বালানি ও সারের দাম বৃদ্ধি প্রভাব ফেলবে না। যদিও কৃষকের লাভ কিছুটা কম হবে।
এর আগে মানুষ চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
এইউএ/এসএম