সামাজিক বিজ্ঞান কী এবং কেন পড়ব?
বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের মতো অনেক ডেভেলোপিং কান্ট্রিতেই, পরিবার এবং বিদ্যালয় থেকে obsessed এর মতো কিছু বিশেষ ক্যারিয়ার অপশনকে জন্মাবধি আওড়ানো হয়। obsess এর বাংলা যাই হোক, যে আচরণের কথা আমি বলছি, আমাদের পরিবারগুলোতে সবাই জানে তার সীমা কতটা পাগলামিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। বাচ্চাদের ধরে ধরে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তুমি ডাক্তার হতে চাও নাকি ইঞ্জিনিয়ার?’।
ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার এর বাইরে বাংলাদেশি পরিবারগুলো গত দুই দশকে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কল্যাণে আরও চিনেছে বিবিএ। এর বাইরে কোনো প্রফেশনাল পছন্দে আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রকাশই তেমন হয় না এবং কেউ কেউ কিছুটা এর বাইরে বের হলে সেটাকে হাস্যকর/কৌতুকের বিষয় বানিয়ে ফেলা হয়।
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের তরুণদের কাছে পেশার বিকল্প হিসেবে সোশ্যাল সায়েন্সের ভালোমন্দ দিকগুলো কিছুটা তুলে ধরা। আমার পাঠক মূলত অষ্টম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। তবে, আশা করছি এর কিছু অংশ অনার্স পড়ুয়া যেকোনো শিক্ষার্থীরও কাজে লাগবে।
‘সামাজিক বিজ্ঞান’ মূলত অনেকগুলো স্পেশালাইজেশনের একটি কালেকশন। বাইরের দেশে একে ‘কলেজ’ এবং ‘ফ্যাকাল্টি’ বলা হয়। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির মধ্যে আছে বর্তমানে ১৬ টি বিভাগ। অর্থনীতি, রাজনৈতিক বিজ্ঞান, পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন, সমাজবিজ্ঞান, নৃ-তত্ত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিভাগগুলো সোশ্যাল সায়েন্সের মধ্যে পড়ে। কিন্তু, এটাও মনে রাখতে হবে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এই বিষয়গুলো কলা অনুষদের মধ্যে পড়ে।
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সটি যে কারণে ‘মাস্টার্স ইন সোশ্যাল সায়েন্স’, কিন্তু পরবর্তীতে আমার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটির মাস্টার্সটি ‘মাস্টার্স ইন আর্টস’-এর সার্টিফিকেট দিয়েছে। এই তথ্যটা উল্লেখ করার কারণ, এই পার্থক্যগুলো এত পরিষ্কার না কিন্তু এবং তাতে কিছু যায়ও আসে না। যেমন, সাহিত্য মূলত সব জায়গাতেই কলা বিভাগের মধ্যে পড়ে, কিন্তু যখন সেই সাহিত্যের মধ্যেই সমাজ, সমাজের বিবর্তনকে দেখানো হবে তখন তাকে সোশ্যাল সায়েন্স বলা যায়।
আবার ইতিহাস বিভাগ হিসেবে বিবেচনা করলেও তা কলা বিভাগের মধ্যে, কিন্তু অর্থনৈতিক ইতিহাস বিষয়টি অর্থনীতির শাখা হিসেবেই অনেক জায়গায় পড়ানো হয়। আবার, অনেক জায়গায় অর্থনীতি বিজনেস ফ্যাকাল্টিতেও পড়ানো হয়।
একটা ওভারভিউ দিয়ে শুরু করা যাক। প্রথমে, অর্থনীতি নিয়েই-যেহেতু আমার পড়াশোনা অর্থনীতিতে। পাঠ্যবইয়ের সংজ্ঞা হবে, অর্থশাস্ত্র দ্রব্য এবং সেবার ভোগ, উৎপাদন এবং বণ্টন। এই বাক্যের অর্থ বোঝা বেশ কঠিন, তাই ভাগ করা যাক। ভোগ - consumption - হচ্ছে প্রতিদিন আমরা যা যা ব্যবহার করি, কিছু না কিছু প্রয়োজনে। যেমন, আমি চাল কিনে ভাত খাই - আমি চাল consume করি বাজার থেকে মূল্য দিয়ে কিনে এনে। আবার, আমি স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করি। এখানে, আমি স্কুলে বেতন দিয়ে এডুকেশন consume করি।
অন্যদিকে, production হচ্ছে আমি বাজার থেকে জিনিস কিনতে টাকা পাওয়ার জন্য যা যা করি। এটা হতে পারে, আমি শিক্ষকতা করি - তাহলে আমি এডুকেশন প্রোডিউস করি। আবার, আমি ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংকের সেবা (সার্ভিস) নেই। এই সম্পূর্ণ সার্কেল - আমি কি ভোগ করি, কি উৎপাদন করি, কি সেবা নেই - এই নিয়েই অর্থনীতির আলোচনা।
আবার, এখানে আমার বদলে যদি একটি দেশ হয় - দেশ তার সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে উৎপাদন, ভোগ এবং বণ্টন করে। একা আমি বা পুরো দেশের বাইরে, চিন্তা করা যেতে পারে, একটি গ্রাম বা একটি জেলা, কিংবা পুরো সাউথ এশিয়া নিয়ে। এক কথায় এখন-সীমিত সম্পদ কীভাবে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ উৎপাদন/ভোগ করা যায়, তাই নিয়েই অর্থনীতির আলোচনা।
যেমন, আমার স্পেশালাইজেশন ‘এনভায়রনমেন্টাল ইকনমিক্স’। আমার পিএইচডি থিসিসে আমি কীভাবে সরকারি পলিসির কারণে মানুষ পরিবেশের দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান হয়, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি ডাটা থেকে বের করার চেষ্টা করি যে কোনো একটি পরিবেশজনিত পলিসি দ্বারা মানুষের ভালোমন্দ হয় কি না। আমার কাজ পুরোই তথ্যভিত্তিক - অ্যাপ্লাইড ইকনমিক্স যেটাকে বলে।
অন্যদিকে, সমাজবিজ্ঞান শাস্ত্রের কাজ হচ্ছে মানুষ এবং সমাজের উন্নয়ন, গঠন এবং কাঠামো নিয়ে আলোচনা করা। বোঝার চেষ্টা করা হয়, মানুষ কেন যোগাযোগ করে, কীভাবে করে, বৈষম্য কীভাবে সমাজে কাজ করে, বিভিন্ন উন্নয়নের ফলে সমাজে কি পরিবর্তন হয় ইত্যাদি।
সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যেমন অপরাধ বেড়ে যাওয়া, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বেড়ে যাওয়া, নারী-পুরুষের বৈষম্যের কারণে কি কি সমস্যা তৈরি হয় - এই নিয়েও সমাজবিজ্ঞান কাজ করে। এরপরে, পলিটিকাল সায়েন্সের কাজ হচ্ছে দেশ, শহর, জেলা ইত্যাদি সব লেভেলের রাজনৈতিক ইন্টারেকশন নিয়ে কাজ করা।
একটা বিশাল অংশ মূলত পার্টিশান ইনভলভমেন্ট নিয়ে কাজ করে। আবার, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মূলত রাষ্ট্রে বিভিন্ন কাজে কীভাবে ব্যবস্থা করা হবে, পাবলিক পলিসি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, এই নিয়ে আলোচনা করে। অন্যান্য সোশ্যাল সায়েন্সের বিশাল অংশ মূলত সমাজবিজ্ঞানের থেকে বের হয়ে তৈরি হওয়া স্পেশালাইজেশন।
অনেকক্ষেত্রেই মনে হতে পারে, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, পলিটিকাল সায়েন্সের অনেক গবেষণাক্ষেত্রই একে অপরের সাথে জড়িত। এর কারণটা সোজা, সমাজ অবিচ্ছিন্ন একটা কাঠামো—সোশ্যাল সায়েন্সের বিভিন্ন অংশকেই বোঝার চেষ্টা করে। তাই, আমার কারেন্ট ইকনমিক্সে প্রজেক্টে যখন আমি ভোটিং বিহেভিয়ার বোঝার চেষ্টা করছি, তখন একে ইকনমিক্স বা পলিটিকাল সায়েন্স দুইদিকেই প্লেস করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু, এই প্রতিটি সাবজেক্টের আলাদা আলাদা Toolbox আছে।
আমি যখন মূলত ইকনমিক্সের Toolbox ব্যবহার করব, তখন একে মূলত ইকনমিক্স বলা হবে। আর এই Toolbox এ কী আছে, সেটাই শেখানো হয় এই বিষয়গুলোতে। যেমন, ইকনমিক্স অন্যান্য সোশ্যাল সায়েন্সের থেকে অনেক বেশি কোয়ান্টিটেটিভ। ম্যাথ এবং পরিসংখ্যানের বিশাল ব্যবহার ইকনমিক্সে করা হয়, যেটা অন্যান্য সোশ্যাল সায়েন্সে কম। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলোর অনেক ওভারল্যাপ আছে।
সামাজিক বিজ্ঞানের বিভাগগুলোর শর্ট ইন্ট্রোডাকশনের পর স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদের প্রশ্ন আসবে - এইসব বিষয়ে পড়ে কি ক্যারিয়ার সামনে খোলা থাকবে? জীবনের একটা বিশাল অংশ জুড়েই থাকবে ‘কাজ’, সেই কাজের আনন্দের জন্য একটা জুতসই ক্যারিয়ার খুব জরুরি। ক্যারিয়ার হওয়া উচিত এমন একটা কাজ যা প্রতিদিন নতুন কিছু শেখাবে, যা করতে ভালো লাগবে। দেখা যাক, সোশ্যাল সায়েন্স আমাদের কি ক্যারিয়ারের দিকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে সোশ্যাল সায়েন্সে কাজের ক্ষেত্রগুলো নিচে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি—
প্রথমত, একাডেমিক: বিশ্ববিদ্যালয়-লেভেলে শিক্ষকতা করা যায়। এর জন্য দেশে কেবল অনার্স বা মাস্টার্স লাগে। কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে পিএইচডি এবং আরও বেশি (পোস্টডক) থাকা লাগে। পাবলিকেশনের প্রয়োজন হয়।
দ্বিতীয়ত, ডেভেলপমেন্ট সেক্টর: ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউএনডিপি ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সোশ্যাল সায়েন্সের বিভিন্ন সেক্টরের মানুষের প্রয়োজন অনেক বেশি। এইসব চাকরির ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ সময়েই পিএইচডি প্রয়োজন হবে। কিছু জুনিয়র লেভেলে শুধু মাস্টার্স যথেষ্ট।
তৃতীয়ত, এনজিও সেক্টর: দেশে এবং বাইরে এনজিও সেক্টরে কনসালটেন্সি করা অনেকেরই প্রথম পছন্দ থাকে। প্ল্যানিং বিষয়ক অন্যান্য চাকরিতেও সোশ্যাল সায়েন্সের অনেক চাহিদা।
চতুর্থত, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি: ফাইন্যান্সিয়াল এনালিস্ট ধরনের অনেক জবে ইকনমিস্টদের চাহিদা থাকে।
পঞ্চম, ব্যাংকিং: সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টরে ইকনমিক্সের ছাত্রদের চাহিদা অনেক বেশি।
ষষ্ঠ, সরকারি চাকরি: সরকারি চাকরি এবং আধা-সরকারি চাকরিতে সোশ্যাল সায়েন্সের অনেক ছাত্রই যায়। বাংলাদেশের অনেক নামকরা সোশ্যাল সায়েন্টিস্টই সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন এবং পাবলিক পলিসিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
সপ্তম, ইন্ডাস্ট্রি জব: ইন্ডাস্ট্রিতে জব করা অনেকেরই প্রধান লক্ষ্য থাকে। ডাটা সায়েন্টিস্ট হিসেবেও অনেকে কাজ করতে পছন্দ করেন।
অপর্ণা হাওলাদার ।। গবেষক
[email protected]