বায়ু দূষণ কি করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ায়?
ঢাকার বায়ু দূষণ নিয়ে ২৬ জানুয়ারি ঢাকা পোস্ট এ আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। বায়ু দূষণের কারণ ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর থেকে মুক্ত থাকার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ওই লেখায়।
করোনা বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন এবং মৃতের সংখ্যা এখন প্রায় ৬ মিলিয়ন। রোগের বিস্তারকে কমানোর জন্য, আমাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে কেন কিছু জায়গায় অন্য জায়গার তুলনায় সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
একটি কারণ যা এটিকে আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে তা হলো বায়ু দূষণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সূক্ষ্ম কণা পদার্থ (PM2.5, এগুলো ২.৫ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট কণা), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO₂) এবং সালফার ডাই অক্সাইড (SO₂) এর মতো দূষণকারীর দীর্ঘমেয়াদি এক্সপোজার ফুসফুসের কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে এবং শ্বাসকষ্টের অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
এই দূষণকারীগুলো অল্প বয়সীদের মধ্যেও ক্রমাগত প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্টকে লক্ষ্য করে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
যে প্যাথোজেনটি করোনার সংক্রমণ ঘটায় সেটি SARS-CoV-2 মতো একটি ভাইরাস। বেশকিছু গবেষণায় ইতিমধ্যেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, বাতাসের দুর্বল গুণমান মানুষকে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে এবং গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রতি ঘনমিটারে ১ মাইক্রোগ্রামের PM2.5 ঘনত্বের বৃদ্ধিও করোনা মৃত্যুর হার ৮% বৃদ্ধি করে থাকে। নেদারল্যান্ডসে আরেকটি গবেষণায় করোনা কেস এবং বায়ু দূষণের এক্সপোজারের মধ্যে সম্পর্ক পেয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রতি ঘনমিটারে ১ মাইক্রোগ্রামের PM2.5 ঘনত্বের বৃদ্ধিও করোনা মৃত্যুর হার ৮% বৃদ্ধি করে থাকে।
২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মো. শরীফুল হাসান ও তার দলের গবেষণার মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন ঢাকায় বায়ু দূষণের সাথে করোনার সম্পর্ক রয়েছে।
আমরা জানি যে, বায়ু দূষণ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এসব স্বাস্থ্য সমস্যা করোনা সংক্রমণ থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ায়।
হার্ভার্ড টি. এইচ. চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথ (Harvard T.H. Chan School of Public Health)-এর একটি গবেষণা বলছে যে, দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার ফলে করোনার প্রভাব আরও খারাপ হতে পারে।
শিয়াও ইয়ু (Xiao Wu) এবং র্যাচেল নেথেরি (Rachel Nethery) এবং সিনিয়র লেখক ফ্রান্সেস্কা ডোমিনিসির নেতৃত্বে হার্ভার্ড চ্যানের গবেষণায় করোনা ও বায়ু দূষণের মধ্যে একটি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। যদিও গবেষণাটি দেখাননি যে, বায়ু দূষণ সরাসরি একজন ব্যক্তির করোনায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে। এই গবেষণায় বায়ু দূষণের দীর্ঘমেয়াদী এক্সপোজার এবং উচ্চতর করোনা মৃত্যুর মধ্যে একটি সম্পর্ক দেখিয়েছেন।
তাদের গবেষণা যে পরামর্শগুলো দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু দূষণ করোনা মৃত্যুর হারকে প্রভাবিত করছে। চীনের ১২০টি শহর বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বায়ু দূষণ এবং করোনা সংক্রমণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন এবং ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির ৬৬টি অঞ্চলে করোনায় মৃত্যুর মধ্যে ৭৮% সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি অঞ্চলে ঘটেছে।
দূষিত বায়ু শ্বাস নেওয়ার ফলে সার্স (Severe Acute Respiratory Syndrome, SARS), ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অন্যান্য অনেক শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ বাড়া ও এর ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার প্রমাণও পূর্ববর্তী সময়েও মিলেছে।
চীনের ১২০টি শহর বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বায়ু দূষণ এবং করোনা সংক্রমণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন এবং ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির ৬৬টি অঞ্চলে করোনায় মৃত্যুর মধ্যে ৭৮% সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি অঞ্চলে ঘটেছে।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, PM2.5, PM10, CO, NO2, SO2 এবং O3-সহ বেশকিছু বায়ু দূষক, করোনায় মৃত্যুর হার বাড়ায়। যদিও, কিছু গবেষণা পরামর্শ দেয় যে, করোনার পরোক্ষ প্রভাব বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করতে পারে। করোনা সংক্রমণ বা মৃত্যু বৃদ্ধির সাথে বায়ু দূষণের সম্পর্ক স্থাপন করে অনেক গবেষক যুক্তি দিলেও এর জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাব রয়েছে।
কিছু গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের তুলনায় SARS-CoV-2-এর বায়ুবাহিত সংক্রমণের হার বেশি। যেহেতু করোনা, বায়ু দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তাই এটি নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা বা করোনা ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে যেসব জায়গায় বায়ু দূষণ একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা এবং যারা দূষিত বায়ুর জন্য অন্যদের তুলনায় বেশি উন্মুক্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, যেমন গৃহহীন এবং যারা দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা সমস্যায় ভুগছেন।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]