ভাষার কান্না ও তরুণ প্রজন্ম
এক.
জীবনানন্দ দাশ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, আশঙ্কাভরা সেই লেখা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ১৯৫১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে এটি প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। আশ্চর্য যে, জীবনানন্দ দাশ প্রথম বাক্যেই বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আশঙ্কার কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান তৈরি হবার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কি হবে-কি হতে পারে—ভেবে দেখেছি মাঝে মাঝে।’ শুরুতেই এই ছোট্ট খটকা বাধে, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে কবির আশঙ্কার প্রধান কারণ ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় বাংলা নামের ভূখণ্ডটারও খণ্ডিত হতে পারত, কিন্তু তিনি বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কিত হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তান তৈরি হওয়ার ফলে।
এ প্রবন্ধে তিনি লিখে গেছেন, ‘যে বাঙলা একদিন ভাত-কাপড়ে ঘরে তৃপ্তি পেয়ে গল্প, রূপকথা, বচন, ছড়া ইত্যাদি তৈরি করেছিল বাঙলার সে হৃদয় নেই এখন, সে সব লোক নেই, সে প্রবাদ, ছড়া, লেখন নতুন কোনো যুক্তিগণ ক্রমবিকাশ লাভ করল না, মরেই গেল-মানুষই মরে যাচ্ছে বলে।’ তার আশঙ্কা একদমই ভুল হয়নি। বরং এত বছরেও তা সমকালীন।
দুই.
ভাষার কান্না আবার কি? যারা এ-কথা বলবেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমি কিন্তু প্রতিদিন ভাষার কান্না শুনতে পাই। আমার মতো অনেকেই ভাষার কান্না শোনেন। কিন্তু খেয়াল করেন না। আবার খেয়াল করলেও গুরুত্ব দেন না। আবার যারা গুরুত্ব দেন তারা অসহায় বোধ করেন। কান্না শুনে করবেনই বা কী? আসলেই তো ভাষার কান্না শুনে কী-ই বা করার আছে।
চারিদিকে তো কত কান্না! চাল-ডালের কান্না, পেঁয়াজের কান্না, যার গুণ নেই সেই বেগুনেরও কান্না। ভোজ্য তেলের কান্না, বিদ্যুতের কান্না, গ্যাসের কান্না প্রতিদিনকার হয়ে উঠেছে। আসলে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস—এরা কাঁদে না। কাঁদি আমরা সাধারণ মানুষরা। বাজারে গিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখে কাঁদি। এই কান্না অবশ্য চোখে দেখার কান্না নয়। এটা বুকের ভেতরের কান্না। দেখা যায় না। অনুভব করতে হয়।
ভাষার কান্নাও অনুভব করি প্রতিদিন। রাস্তায় বেরুলেই ভাষার কান্না খুব বেশি অনুভব করি। অফিসে-আদালতের সামনে সাইনবোর্ডগুলো দেখলেই ভাষার জন্য বুকের ভেতরে হাহাকার বাড়ে, শুধু বাড়েই। এটা ফেব্রুয়ারি মাস বলেই নয়।
আমার মাতৃভাষা কোথাও নেই। যদিওবা কোথাও আছে খুবই ছোট ... দূরবীন দিয়ে দেখতে হবে। অধিকাংশ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। গোটা গোটা ইংরেজি শব্দ। বাংলা শব্দ কোথাও নেই। অথচ নির্দেশ আছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু থাকতে হবে। ইংরেজি ভাষার ওপর আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। যে যাই বলুক ইংরেজি না জানলে আমরা বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মোটেই তাল মিলাতে পারব না। সেজন্য ইংরেজির প্রতি আমাদেরকে গুরুত্ব দিতেই হবে। তাই বলে মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলে যাব? তাহলে কেনইবা ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে এই দেশে রক্ত ঝরেছিল? ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শহীদ হয়েছিল কেন আমাদের পূর্বপুরুষরা?
তিন.
যে ভাষায় মা-বাবা কথা বলেন, যদি সেটা পুরনো ভাষা হয়ে থাকে এবং নতুন একটি ভাষা এসে বনেদি ভাষায় পরিণত হয়, তাহলে এই মা-বাবার সন্তানেরা মূলত নতুন ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়বেন। পুরনো ভাষা ব্যবহার করবেন কম এবং তাদের জীবনে নতুন ভাষার জয়জয়কার সুনিশ্চিত। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন জন্মাবে, তখন তারা একেবারেই পুরনো ভাষা ব্যবহার করবে না, তারা শিখে নেবে বিজয়ী ভাষা, যা তার মাতৃভাষা নয়।
কেন এ রকম ঘটনা ঘটে, সে ব্যাপারে অনেকেরই ধারণা আছে। উপনিবেশ কিংবা যুদ্ধের কারণে অন্যের ভূমি জবরদখল করা জাতি এই সর্বনাশের জন্য দায়ী। আবার কখনো একদল মানুষ যখন জীবনের অবধারিত প্রয়োজনে অন্য কোনো এলাকায় যেতে বাধ্য হয় এবং সে এলাকায় মানুষ যদি কথা বলে অন্য ভাষায়, তাহলে তারা ধীরে ধীরে সেই নতুন ভাষাতেই কথা বলা শুরু করে। তাদের সন্তানেরা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দ্রুত এই নতুন ভাষাকে বরণ করে নেয়। শিল্পায়ন, নগর সভ্যতা, ভিন্ন ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ, টেলিভিশনসহ অন্যান্য প্রচারমাধ্যমের প্রভাবে নানা কারণে ভাষা হারিয়ে যেতে থাকে।
আমরা যখন আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা মরে যেতে দেখি এবং সেই ভাষার জায়গায় ইংরেজি, স্প্যানিশ কিংবা ফ্রেঞ্চ ভাষায় আধিক্য দেখি, তখন বুঝতে পারি সংস্কৃতির গোড়া ধরে টান দিয়েছে উপনিবেশ, ভাষাসহ ঐতিহ্যের শিকড় ধরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে আত্মপরিচয়। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় মানুষ কোনো কোনো মহাদেশের মানুষের সঙ্গে এই নির্মম আচরণ করেছে, সেটা কেউ ভুলে যায়নি। ভিনদেশের ভাষা মাথার ওপর ছড়ি ঘোরায়।
চাকরি পাওয়ার মূল যোগ্যতা যদি হয়ে থাকে ভিন ভাষা, যেকোনো প্রতিষ্ঠিত জায়গায় কথা বলার সময় বিজাতীয় ভাষা যখন হয়ে ওঠে শক্তিশালী মাধ্যম, নিজ দেশের ভাষা হয় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ব্যাপার, তখন এমনিতেই সেই রাজ ভাষার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে মানুষ। মাটির দখল ছাড়াই এগিয়ে যেতে থাকে এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
চার.
মানুষের জীবনযাপনে ভাষা যেখানে স্বাভাবিক, সেখানে বাংলা ভাষাও পৃথিবীর আর সব ভাষার মতো দারুণ ও সজীব। গভীর ও আবেগের প্রকাশ সত্ত্বেও সাধারণভাবে মাতৃভাষা তথা বাংলাভাষার ব্যবহারিক দিকে গভীর চর্চার ক্ষেত্রটি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সেখানে শিক্ষায়তনে ইংরেজি মাধ্যমের ব্যাপক দুর্মূল্য দাপট। এই দাপট যেমন শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমনি জীবিকার ক্ষেত্রেও।
করুণমুখ বাংলাভাষা সেখানে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। তাই বাংলার ভাষার অনুশীলন দ্রুত কমতে শুরু করেছে, সেখানে শ্রম, সময় ও আন্তরিকতার অভাবও দেখা যাচ্ছে। স্বভাবতই অবহেলার পরিণামে বাংলার শুদ্ধচর্চা, নির্ভুল বলা ও লেখার ক্ষেত্রটি ছোট হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে যেমন প্রবণতার প্রভাব পড়ছে তেমনি পড়ছে এর বাইরেও।
বানান-ভুল, শব্দ ব্যবহারে ভুল, উচ্চারণে ভুল, কথকতায় বা বক্তৃতায় বা টিভির টকশো’তে ইংরেজি বাংলার দোশালা স্থূল ব্যবহার চেতনায় আঘাত করে না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা ‘স্মার্টনেস’ এর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এফএম রেডিওর স্থূল, কখনো আপত্তিকর বাংলা-ইংরেজির ব্যবহারিক প্রচার আপাত বিচারে সরস ও তির্যক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বাংলা ভাষার করুণ অবস্থারই প্রমাণ তুলে ধরে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব দেখার কেউ নেই। নিয়ন্ত্রণের কারো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। বাংলা ভাষার ব্যবহার সত্যিই এক ব্যাপক উদাসীনতার শিকার।
রাষ্ট্রভাষাকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এ বিষয়টিকে আমরা গর্ব ও অহংকারের সঙ্গে গ্রহণ করেছি। কিন্তু জাতীয় জীবনের যে ঘটনা সেটাকে আমরা সরিয়ে রেখেছি। ঔপনিবেশিক রাজকীয় ভাষা ইংরেজি আগে যেমন ছিল সে অবস্থানেই থেকে গেল। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালত থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার বদলে ইংরেজি ব্যবহার চালু থেকে গেল। বাংলা ক্রমে অবহেলিত হয়ে পড়ল এবং পিছু হটল। বাংলা শিক্ষা এবং বাংলা ভাষা নির্ভুলভাবে বলা, লেখা এবং চর্চার দিকটাতে একটা উদাসীনতা ও অবহেলা থেকেই গেল। ভাষা আন্দোলনের সেই ‘সর্বস্তরের বাংলা চালু কর’ স্লোগানটি কেবল স্লোগান হিসেবে থেকে গেল।
পাঁচ.
ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই না বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়। অথচ সেই মাতৃভাষার অবস্থানটা এখন কোথায়? কোন স্তরে উপনীত হয়েছে? ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো’—এই স্লোগান তো ছিল সেই বায়ান্ন’তে। আজও কি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে? দেশের শিক্ষা পদ্ধতি সামাজিক শিষ্টাচার, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই মূলত ভাষার বিকাশ ঘটে। বাস্তবে এই মাধ্যমগুলো মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক?
এখন ভাষার মাস। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হলেও এই মাসে সর্বস্তরেই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় অনেক কথাবার্তা হবে। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হবে। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কান্নাকাটিও করবেন কেউ কেউ। টেবিল থাপড়ে বক্তৃতা দিতেও পিছ পা হবেন না। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় অনেক ভালো ভালো কথা বলবেন সবাই। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস পার হলেই সকলেই বেমালুম ভুলে যাবেন সব টেবিল চাপড়ানো সব কথা।। তখন ভাব-ভঙ্গিটাই এমন হবে—কীসের বাংলা ভাষা!
ছয়.
আমাদের শিক্ষার প্রধান সমস্যাটা কী? কয়েক ভাগে তা বিভক্ত হয়ে আছে। আরবি-ফারসি-উর্দুতে এক অংশ পড়ছে, আরেক অংশ পুরো ইংরেজিতে পড়ছে, আরেক অংশ বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে পড়ছে, আরেক অংশ বাংলার নামে ইংরেজি ভার্সনে পড়ছে। কিন্তু শিক্ষাটা হওয়া উচিত ছিল প্রথম ভাষা বাংলায়। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা শিখবে। সারা পৃথিবীতে এমনটাই হচ্ছে।
প্রথম কাজটা হবে শিক্ষাকে নতুন করে সাজানো। এ দেশের ভদ্রলোক শ্রেণি আর বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করে না। যারা পারে না, তারাই কেবল বাংলায় পড়ে। আর যারা সেটাও পারছে না, তারা মাদ্রাসায় পড়ছে কিংবা পড়ছে না। এটা একটা ভয়াবহ অবস্থা। রাষ্ট্র তো সেই শ্রেণিই চালাচ্ছে, যারা ইংরেজি সওদা করতে পারছে। চূড়ান্তভাবে সব ধরনের শিক্ষায় বাংলাকে প্রয়োগ করতে হবে।
এই মুহূর্তে শিক্ষায় ‘বাংলা’ প্রয়োগ বাস্তবায়ন করা হয়তো কঠিন। আমাদের ইংলিশ মিডিয়ামগুলোয় কার্যকরভাবে বাংলার প্রচলন করতে হবে। কেননা এই মুহূর্তে ইংলিশ মিডিয়াম সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেই।
ইংলিশ ভার্সন বলে যে শিক্ষাপদ্ধতি আছে, সেটা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। মূলধারার শিক্ষায় কার্যকরভাবে ইংরেজি শিক্ষাটা বাড়াতে হবে। কেননা জনগোষ্ঠীর ইংরেজির চাহিদা আছে। সেখানে সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আমাদের উচ্চশিক্ষায় বাংলা আসলে নেই। আমাদের এখন একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোনো দরকার। সেটা হলো উচ্চশিক্ষায় যাতে বাস্তবিকই বাংলাকে অন্তত অর্ধেক প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলা যেখানে বাদ পড়ে গেছে, সেখানে উচ্চশিক্ষায় তা চালু করাটা এই মুহূর্তে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
সাত.
আমরা বাসা-বাড়িতেও কি প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় কথা বলি? সাহেব-মেম সাহেব টাইপের পরিবারকে দিয়ে তো বাংলাদেশকে বিচার-বিশ্লেষণ করা যাবে না। নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের কথা বলি।
পরিবারের কর্তা রিকশা চালায়। পরিবারের স্ত্রী সদস্য অন্যের বাসা-বাড়িতে কাজ করে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে সাধারণ স্কুলে পড়ে। প্রাইভেট মাস্টার রাখার সামর্থ্য নাই। তাই স্কুলের পড়াশোনাই মূল ভরসা। পরিবারটির একমাত্র বিনোদন মাধ্যম হলো টেলিভিশন। দেশের টিভি চ্যানেলের চেয়ে বিদেশি টিভি চ্যানেল এই পরিবারের বেশি প্রিয়। সে কারণে মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে পাশের দেশের হিন্দি ভাষা এই পরিবারের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাতৃভাষা তার মর্যাদা ‘ঠিকঠাক’ পাচ্ছে তাহলে?
আট.
অনেকেই মনে করে থাকেন, বাংলাদেশ এক জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর দেশ। সংখ্যার বিচারে এ দেশে মূলত বাঙালিরাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু স্বীকার করে নিতে হবে, এই দেশে আরও অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাস। সংখ্যায় অল্প হলেও তারা নিজ ভাষায় কথা বলে, নিজ সংস্কৃতিকে সম্মান করে। এদের ভাষা বাঁচিয়ে রাখার একটা দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্রের।
যেসব জায়গায় দলবদ্ধভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস, সেসব জায়গায় যে স্কুলগুলো হবে, সেগুলোয় তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির আদলে গড়ে উঠতে হবে পাঠ্যক্রম। তারা যেন নিজের ভাষায় নির্বিঘ্নে কথা বলতে পারে, নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে পারে, সে আবহ থাকতে হবে। নইলে এই ভাষা এবং ভাষাগোষ্ঠীগুলো বাঁচানো যাবে না।
কর্পোরেট সংস্কৃতির তৈলাক্ত সংস্কৃতি কিংবা বিশ্বায়নের একমুখী যান্ত্রিক উন্নতি মানুষের মানবিক জায়গাটার ক্ষতি করছে। এই বিশাল শক্তিশালী দৈত্যের হাত থেকে মানুষের মুক্তি আসবে কী করে, সে রাস্তা এখনো তৈরি হয়নি।
নয়.
তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ তারাই তো মাতৃভাষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? বাস্তবতা যা-ই হোক, সেই তরুণদের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের দায়টাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা জরুরি। আমরা কতটা পেরেছি তাদের জন্য একটা উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে, এগুলো ভাববার বিষয়।
তরুণ সমাজ, নতুন প্রজন্ম যদি মনে করে, আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা, সেই হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা জীবিকার ভাষা হওয়া উচিত, আমাদের উচ্চশিক্ষা, উচ্চ আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা হওয়া উচিত, তা নিয়ে আন্দোলন করা উচিত তাহলে তারা আন্দোলন করবে। তারা যদি আন্দোলনে এগিয়ে আসে তাহলেই সম্ভব, নইলে তা সম্ভব নয়।
তরুণ প্রজন্ম সংগ্রাম করে বাংলা ভাষা অর্জন করেছে। এখনকার তরুণ প্রজন্ম যদি সচেতন হয়, জাতি-রাষ্ট্র কাকে বলে এই বিষয়টা যদি বুঝে জীবিকার ভাষা মনে করে বাংলাকে এবং জাতীয় জীবনের সর্বস্তরের ভাষা এই বোধে যদি তারা সক্রিয় হয়, তাহলেই একমাত্র তা কার্যকর হবে। ভাষার কান্নাও থেমে যাবে।
হাবীব ইমন ।। সাংবাদিক