গেস্টরুম আতঙ্ক বন্ধ হবে কবে?
গত কয়েকদিনের দুটো সংবাদ শিরোনাম দেখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের গণরুমের এক ছাত্র মো. আকতারুল ইসলাম একই হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দ্বারা গেস্টরুমে নির্যাতনের শিকার হন। এটি গত ২৭ জানুয়ারির সংবাদ। আর ১৮ ফেব্রুয়ারির সংবাদ হলো, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোল্লা তৈমুর রহমান ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দ্বারা ‘গেস্টরুম নির্যাতনের’ শিকার হন।
গত ১০ বছর কিংবা তারও আগের পরিসংখ্যান দেখলে এইরকম প্রচুর ঘটনা জানা যাবে। এফ রহমান হলে ছাত্রনেতার গুলিতে নিহত হওয়ার উদাহরণও আছে। এসএম হলের ছাদে ঘুমাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক জীবন কেমন? নানা দেশ থেকে নানা ভাষার, নানা ধর্মের, নানা জেন্ডারের শত শত স্বপ্নবান শিক্ষার্থী দিয়ে ঠাসা থাকে তাদের আবাসিক হলগুলো। হলে থাকার পরিবেশ যেন তিন তারকা হোটেল। খাওয়ার পরিবেশ, পড়ার পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা যেন শিক্ষার্থীরা আনন্দ নিয়ে নির্বিঘ্নে ক্লাস, পড়াশোনা এবং গবেষণা করতে পারে। এই সময়টাই একজন শিক্ষার্থীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সেইসব আবাসিক হলগুলো কোনো শিক্ষক চালায় না। কিছু কর্মকর্তাই যথেষ্ট।
অনেকের কাছে গেস্টরুম নাম শুনলে মনে হতে পারে এটি অতিথি আপ্যায়নের রুম। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এটি হলো প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের রুম।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো যেন কয়েদখানা। আমাদের কারাগারগুলোর পরিবেশ যেমন অমানবিক, ঠিক তেমনি আমাদের আবাসিক হলগুলো।
সবকিছু মিলিয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যাতে কর্মকর্তা দিয়ে আবাসিক হলগুলো চালানো না যায়। সর্বদা খাবার নিয়ে কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে মারামারি, রাজনৈতিক কারণে মারামারি, চুরিচামারি ইত্যাদি নিয়ে নানা অভিযোগ লেগেই আছে। এইসব অভিযোগ সুরাহা করতে মনে করা হয় শিক্ষকরা এই দায়িত্ব পালন করলে শিক্ষার্থীরা নিয়মকানুন মানবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা দিয়ে একদম অসম্ভব। অথচ আমরা জানিই না এইসব অতিরিক্ত বা বাড়তি ঝামেলা থাকারই কথা না।
শিক্ষার্থীরা যদি বিশ্বের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতো তাহলে শিক্ষকদের প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষক হতে হয় না। এই শিক্ষকদের সিট বণ্টনের মতো একটা ক্লারিক্যাল কাজও করতে হয় যেইটা সাধারণ একজন কর্মকর্তাও করতে পারত। শিক্ষকদের কাজ তো হোটেল চালানো না। বড়জোর শিক্ষকরা সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে থাকতে পারত।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে (বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে) এক আতঙ্কের নাম। যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক মজবুত করার নামে যা চালায় তা বিশ্বে নজিরবিহীন।
গত ২০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিধানে কিছু নতুন শব্দ যোগ হয়েছে, যেটা আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ছিল না। শব্দগুলো হলো ‘গণরুম’ এবং ‘গেস্টরুম’! শুনতে কত সুন্দর শোনায়। নিশ্চয়ই গণমানুষের রুম মানে গণরুম এবং অতিথি আপ্যায়নের রুম হলো গেস্টরুম। আদতে তা নয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাসীন দলের তথাকথিত ছাত্রনেতাদের প্রতি আচরণ শেখানো এবং নিয়মনীতি শেখানো হয় গেস্টরুমে। এখানে ডেকে এনে শেখানো হয় রাজনৈতিক বড় ভাইদের দেখলে কীভাবে সালাম দিতে হয়...
গেস্টরুম হলো, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কনসেন্ট্রেশন রুম আর গণরুম হলো তাদের সংগঠনের কর্মী সরবরাহ কেন্দ্র। অনেকের কাছে গেস্টরুম নাম শুনলে মনে হতে পারে এটি অতিথি আপ্যায়নের রুম। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এটি হলো প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের রুম।
মূলত, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাসীন দলের তথাকথিত ছাত্রনেতাদের প্রতি আচরণ শেখানো এবং নিয়মনীতি শেখানো হয় গেস্টরুমে। এখানে ডেকে এনে শেখানো হয় রাজনৈতিক বড় ভাইদের দেখলে কীভাবে সালাম দিতে হয়, শেখানো হয় ডাকা মাত্রই দৌড়ে মিছিলে যোগ দেওয়া ইত্যাদি।
শুনেছি, তারা শেখায়, হ্যান্ডশেক করার সময় বাম হাত পেছনে রাখতে হয়, শেখানো হয় বড় ভাইদের দেখা হলেই সালাম দিতে হবে। জানানো হয়, নেতাদের নাম মুখস্থ রাখতে হবে। এইসব শেখানো আচরণ থেকে বিচ্যুতি ঘটলে গেস্টরুমে ডাকা হয় এবং নির্যাতন করা হয়।
কল্পনা করতে পারেন, যে বয়সে আমাদের ছেলেমেয়েরা জ্ঞানবিজ্ঞান শিখতে-জানতে ব্যস্ত থাকবে সেই বয়সে ছেলেমেয়েদের কয়েদখানায় বন্দিদের মতো করে নির্যাতন করা হয়। এখানে খাওয়াদাওয়া সেই জেলখানার মতো।
এইসব জেনেও আমরা শিক্ষকরা চুপ, প্রশাসন চুপ, সরকার চুপ, অভিভাবকরা চুপ। এরা বড় হয়ে কীভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে কথা বলবে? কীভাবে মুক্তচিন্তা করবে? কীভাবে বড় বিজ্ঞানী বা গবেষক হবে? এতকিছু জেনেও এই যে আমরা চুপ করে আছি এর ফল আমাদের সম্মিলিতভাবে ভোগ করতে হবে।
সত্যি বলতে কি, আমরা ইতিমধ্যে ভোগা শুরু করেছি। দেশে আজ মেরুদণ্ডসম্পন্ন মানুষ নেই। সৎ মানুষ নেই। লেখাপড়া করে সার্টিফিকেট পাচ্ছে কিন্তু শিক্ষিত মানুষ নেই। দেশকে গড়তে হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে হবে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়