মাথাপিছু আয় : আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া দেশটি এখন গোটা বিশ্বের বিস্ময়। কেন? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, এর অর্থনৈতিক ও কিছু কিছু সামাজিক উন্নয়ন সূচকের কারণে। যেকোনো অর্জনেরই সমালোচনা বা আলোচনা থাকবেই। এটাই নিয়ম।
দেশের ১০০ ভাগ নাগরিক কখনোই একটি সরকারের সকল অর্জনকে এক চোখে দেখবে না। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে চমক দেখিয়ে আসছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে।
উন্নয়ন হচ্ছে তবে তা সমানুপাতিক হারে সবার ভাগে পড়ছে না। সমাজে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে তড়তড় করে। কিছু লোকের হাতে ধন সম্পদ জমা হচ্ছে এমনভাবে, যার ভাগ দেশের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না কারণ তারা এই অর্থ দেশে রাখছে না।
এমনকি করোনা মহামারির কালে যখন গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে তখন বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে অবাক করা সংখ্যায়। এই অর্জনের ঘোষণা কিন্তু সরকার নিজে দেয়নি। এর স্বীকৃতি এসেছে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই।
এরমধ্যে সুখবর এসেছে আরেকটি। দেশজ উৎপাদনকে হিসাবে আনার জন্য নতুন করে ভিত্তি বছর হিসেবের সিদ্ধান্ত এসেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে জিডিপির অগ্রগতি গণনা করার পর বিবিএস জানালো, আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৫৫৪ মার্কিন ডলার যা আগে ছিল ২২২৭ ডলার। টাকার হিসাবে দাঁড়ায় মাসিক ১৮ হাজার ৩২২ টাকার মতো (ডলারের সর্বশেষ রেইট অনুযায়ী)।
এখন কথা হচ্ছে এত উন্নয়ন কি আসলেই কাগজে কলমে হচ্ছে? আশা করি, এর উত্তর অতি বড় শত্রুও ইনিয়ে বিনিয়ে অস্বীকার করবে না। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। রুচি পরিবর্তিত হয়েছে, চাহিদা বেড়েছে। সাদা চোখে একজন প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কি একদিনেই এসেছে?
একটা ছোট উদাহরণ দেই। উত্তরবঙ্গকে বলা হতো সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল। সেই অঞ্চলের মানুষ একবেলা খায় তো বাকি দুইবেলা না খেয়ে থাকতো। ঘরে জমা চালের কথা তো চিন্তাতেই আনতো না। তিনবছর আগে দিনাজপুর গেলাম শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। সেখানে আগে যারা আমাদের বাড়িতে কাজ করতো তাদের এখন আর ডাকলেও পাওয়া যায় না।
কেন আসে না, প্রশ্নের উত্তরে আমার চাচা শ্বশুর আমাকে নিয়ে গেলেন পাশেই একজনের ঘরে, যারা আগে কাজ খুঁজে খেত। দেখালেন, তাদের ঘরে এখন বস্তায় করে চাল কেনা থাকে। অর্থাৎ, ভাতের নিশ্চয়তা আছে মানেই তারা সন্তুষ্ট। তিনবেলা ভাত থাকলে তরকারি যেকোনো একটা ম্যানেজ হয়েই যাবে।
আমি জানি, এটা অনেকের কাছেই হাস্যকর উদাহরণ মনে হবে। তবে কেন উন্নয়ন নিয়ে এত সমালোচনা বা পক্ষে বিপক্ষের মতামত? বাস্তবতা হচ্ছে, যখন মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে তখন কেন আমরা খুশি মনে মেনে নিতে পারছি না? এই না পারার কারণটা খুঁজে বের করাটাও সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
আমি যা বুঝি তা হলো, উন্নয়ন হচ্ছে তবে তা সমানুপাতিক হারে সবার ভাগে পড়ছে না। সমাজে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে তড়তড় করে। কিছু লোকের হাতে ধন সম্পদ জমা হচ্ছে এমনভাবে, যার ভাগ দেশের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না কারণ তারা এই অর্থ দেশে রাখছে না। পাচার করে দিচ্ছে দেশের বাইরে বিভিন্ন মাধ্যমে। যে হারে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে তার সাথে তুলনা করলে গরিবরা গরিবই থেকে যাচ্ছে।
তবে সাধারণ মানুষ এত অর্থনীতির মারপ্যাঁচ বোঝে না। বোঝার কথাওনা বা দরকারও পড়ে না।
সমাজে বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু ধনীর তুলনায় এখনো গরিব রয়ে গেছে তাই, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। বাজারের উপর কোনো লাগাম নেই সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের।
আমরা সাধারণ মানুষ উন্নতি বা উন্নয়ন বুঝি অতি সাধারণ কিছু বিষয় দিয়ে। কী সেগুলো? অনেকগুলোর মধ্যে একটা বড় ইন্ডিকেটর হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চাহিদামাফিক আমি আমার আয় সীমার মধ্যে কিনতে পারছি কি না। খাওয়া পড়ার জন্য যখন চিন্তা করতে হয় না তখন প্রশ্ন আসে সংসারের বাকি খাতে আমি কতটা লাক্সারি আনতে পারলাম বা আয়েশিভাবে খরচ করার মতো সাহস অর্জন করতে পারছি কি?
সমাজে বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু ধনীর তুলনায় এখনো গরিব রয়ে গেছে তাই, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। বাজারের উপর কোনো লাগাম নেই সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের।
ভোজ্য তেলের দাম এক লাফে ৭০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকায় উঠে গেছে। সংসারে তো কেবল তেল কিনলেই চলে না। তেল দিয়ে রান্না করার সামগ্রীও প্রয়োজন হয়। অথচ সেগুলোতেও আগুন। সবজির মৌসুমে সহজলভ্য কোনো সবজি নেই বাজারে।
মাছ, মাংস থেকে মসলাপাতিতেও আগুন জ্বলছে। এখন যদি আসি, মাসিক আয়ের হিসাবে। তাহলে যে মানুষটির মাসিক আয় ২৮ হাজার বা ২৯ হাজার টাকা আর সংসারে যদি হয় ৫ জন মানুষ যাদের সবাই আবার রোজগার করে না তাহলে তাদের কাছে এই উন্নয়নের ফসল কখনোই আশীর্বাদ হবে না। পেটে যখন টান পড়ে তখন সুন্দর গানও বেতালের মতো মনে হয়।
সমস্যা হয়ে গেছে, সরকারের অর্জনগুলো কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ের লাগামহীনতার কারণে এমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে বারবার। আমরা সাধারণ মানুষ বলতে পারি। লিখতে পারি। চিৎকার করতে পারি কিন্তু লাগাম ধরতে পারি না। তবে হ্যাঁ। হয়তো আমাদের সংসারের খরচে লাগাম টানা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না কারণ আমাদের আয়ের অঙ্ক যে একই থাকছে।
গ্যাসের দাম বাড়তি, শোনা যাচ্ছে ভর্তুকি কমাতে পানির দামও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। একদিকে আয়ের উপর কর দিচ্ছি। অন্যদিকে ইউটিলিটি ব্যবহারের জন্য গুনতে হচ্ছে উচ্চহারে বিল। বাজারের থলে দিনে দিনে ছোট করতে হচ্ছে। সন্তানের চাহিদাকে চেপে রাখা পিতামাতার কাছে তাই এই মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা বড্ড গোলমেলে ঠেকে।
লীনা পারভীন ।। কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট