জিপিএ-৫, শিক্ষায় বরাদ্দ এবং বাস্তবতা
২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়। আর ২০০৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় এই পদ্ধতি চালু হয়। সেই সময় থেকে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ পদ্ধতি চালু হয়। উদ্দেশ্য উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও উন্নত করে তোলা।
তারপর দেখলাম জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির সূচকীয় বৃদ্ধি! কেন? আগের পদ্ধতিতে প্রথম শ্রেণি যারা পেত প্রথম তারাই জিপিএ-৫ পেয়েছে। হঠাৎ সব পাল্টে যায়! শুনতে পাই, বোর্ড থেকে মন্ত্রণালয় থেকে পরীক্ষকদের কাছে নির্দেশনা যেত, যেন মন প্রাণ খুলে নম্বর দেওয়া হয়। নইলে নানারকম ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিধামকি দেওয়া হয়েছে। এগুলো কী?
আমরা সবাই নিশ্চয়ই স্কুলে উচ্চ লাফ প্রতিযোগিতা দেখেছি। সেখানে কী করা হয়? শুরুতে বারটি খুব নিচে থাকে সবাই অতি সহজেই এটি ডিঙাতে পারে। তারপর আস্তে আস্তে উপরে তোলা হয়। ফলে অনেকেই বাদ পড়ে যায়। যারা উচ্চ লাফ শিখে তাদের ট্রেনিংয়ের সময় উচ্চতার বার ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তাদেরকে ওটা ডিঙানোর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়।
উন্নত বিশ্বে আসলে এটিই করা হয় এবং সেইজন্যই তারা উন্নত। আমরা কী করছি? পরীক্ষাকে খেলো বানিয়ে উচ্চতার বার নামিয়ে দিচ্ছি। প্রশ্নের মান সহজ করে পারলে সবাইকে জিপিএ-৫ দিয়ে দিচ্ছি। এর ফলে তো শিক্ষার্থীদের ব্রেইনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছি না।
এই যে মান নামিয়ে দিচ্ছি এর যে সুদূরপ্রসারী কুফল আছে সেটা কী বুঝতে পারছি? হ্যাঁ, যারা নীতিনির্ধারক তারা ঠিকই বুঝছে। কিন্তু তারা তো এইসব মাথায় রাখে না কারণ তাদের সন্তানেরা তো এই মাধ্যমে পড়ে না। তারা হয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে, না হয় বিদেশে পড়ে। সংকট আসলে এখানেই।
উন্নত বিশ্বে আসলে এটিই করা হয় এবং সেইজন্যই তারা উন্নত। আমরা কী করছি? পরীক্ষাকে খেলো বানিয়ে উচ্চতার বার নামিয়ে দিচ্ছি। প্রশ্নের মান সহজ করে পারলে সবাইকে জিপিএ-৫ দিয়ে দিচ্ছি।
একটি ভালো জার্নাল মানে কী? বিশ্বের সেরা জার্নাল হলো ‘নেচার (Nature)’, ‘সাইন্স (Science)’, ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স (Physical Review Letters)’, ‘প্রসেডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সাইন্সেস অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা (Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America [PANS])’ ইত্যাদি।
নেচার জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশের জন্য পাঠালে ৬০% আর্টিকেল কোনো রিভিউয়ারের কাছে না পাঠিয়ে এডিটোরিয়াল ডেস্ক থেকে বাদ দেওয়া হয়। মাত্র ৭% আর্টিকেল শেষমেশ প্রকাশিত হয়। প্রায় একই কথা বলা চলে বাকি ৩টি উপরে উল্লেখিত জার্নালের ক্ষেত্রেও।
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রায় ১০০টির মধ্যে ১০০টিই প্রকাশিত হয়। যেই জার্নালে প্রাপ্ত আর্টিকেল ১০০টির মধ্যে ১০০টিই প্রকাশের জন্য গৃহীত হয় সেই জার্নালের কোনো মূল্য নেই। ঠিক তেমনি যেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই পাস এমনকি জিপিএ-৫ পাওয়া যায় সেই পরীক্ষার কোনো মূল্য নেই।
২০০৩ সাল থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ পদ্ধতি চালু করা হয়। সেই বছর কয়েক শত জিপিএ ৫ পেয়েছিল। একটা বিজ্ঞাপন ছিল এই রকম, ‘বসুন্ধরার বড় গুন, ২০ বছরে জমির দাম বেড়েছে ৫০ গুন।’ ঠিক তেমনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় গুন। গত ২০ বছরে জিপিএ ৫ বেড়েছে ৩৫০ গুন।
অথচ শিক্ষার মানের ইনডেক্সে বিশ্বে ১৩৮টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৩২ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই যে বললাম, জার্নাল যদি যা কিছু জমা হয় সব প্রকাশ করে দেয় তার যেমন মান থাকে না ঠিক তেমনি পরীক্ষা দিলেই বলা যায় পাস এমনকি জিপিএ-৫ হয়ে যায় তারও কোনো মান থাকে না।
শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দরকার। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো দরকার...
আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষার অবস্থাটা ঠিক তেমনি। আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে না। শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দরকার। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।
১৩ ফেব্রুয়ারি উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার প্রাক্কালে শিক্ষামন্ত্রী বলেন যে, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ বহুগুণ বেড়েছে।’ তিনি আবার বলেছেন, ‘যদিও আমরা এখনো জিডিপির শতকরা ৩ ভাগের কম বিনিয়োগ করছি। কিন্তু টাকার অঙ্কের দিকে তাকালে, শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে যে জাতীয় বাজেট দিয়েছিলেন বর্তমানে শিক্ষার বাজেটই তারচেয়ে বেশি।’
বাস্তবতা হলো, সরকার জিডিপির মাত্র ২.১% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিচ্ছে। এই ২.১% কে ৩% এর কম বলাতে হয়তো মিথ্যা বলা হয় না কিন্তু এখানে ফাঁকিবাজি আছে, যা একজন শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে আশা করা যায় না। অথচ ইউনেস্কো বলেছে, শিক্ষায় যেন জিডিপির ন্যূনতম ৫.৫% বরাদ্দ দেওয়া হয়।
ধরুন, আপনার অনেক টাকা। সেটা কী বাড়ি-গাড়ি করে খরচ করাটা বেশি জরুরি নাকি সন্তানের লেখাপড়ার জন্য খরচ করা বেশি জরুরি? বুঝতেই পারছি, আমাদের হাতে এখন অনেক টাকা। টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, সুউচ্চ ভবন, দালান ইত্যাদি খাতে মেগা প্রজেক্ট নিচ্ছে। রাষ্ট্রকে এখানে পরিবার ভাবলে এ যেন সেই পরিবার, যে তার অর্থবিত্ত সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে খরচ না করে গাড়ি-বাড়ির পেছনে খরচ করছে।
তারা মেগা প্রজেক্ট নিচ্ছে কেবল দুর্নীতিবাজ মানুষ তৈরির জন্য। কিন্তু ছেলেমেয়েদের মানসম্মত লেখাপড়ার জন্য খরচ করছে না বললেই চলে। যতটুকু খরচ করছে সেটা কেবল লোক দেখানো সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে। বেশি বেশি স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়। যেন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সার্টিফিকেট প্রদান করলেই শিক্ষিত হয়ে যায়।
জনগণও সেটা মনে করছে। যেমন রাজা তেমন প্রজা। সবকিছুর আগে শিক্ষায় মেগা প্রজেক্ট নেওয়া উচিত ছিল। অথচ তা না করে আমরা মেগা প্রজেক্ট নিচ্ছি অবকাঠামো নির্মাণে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়