ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হচ্ছে না কেন?
একুশের চেতনায় দ্রোহের দাবানল অগ্নিশিখা হয়ে ছড়াতে থাকে। তখনকার পূর্ব বাংলায় আলোকিত ঝড়ে রূপান্তরিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের জন্য ভাষা আন্দোলনই তৈরি করেছিল শক্তিশালী প্রেক্ষাপট। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম শুরুই হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে।
ভাষা আন্দোলন আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম পাঠ, প্রথম লড়াই। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিণতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম জাতিরাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ভাষার জন্য লড়াই করে।
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মায়ের ভাষা একটি মৌলিক অধিকার। এই ভাষা নিজ পরিচয় বহন করে। ঠিক সে কারণেই বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য আন্দোলনের জোরালো দাবি উঠে এসেছিল গণমানুষের মাঝে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিজ ভাষা রক্ষা করার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল। যদিও এই লড়াইয়ের বীজ ১৯৪৭ সাল পরবর্তী সময় থেকেই মানুষের মাঝে রোপিত হয়ে আসছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আমরা পাঁচজন শহীদের নাম শুনতে পাই, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, এই বিশাল আন্দোলনে জড়িত ভাষাসৈনিক বা ভাষা শহীদের সম্পূর্ণ তালিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ পর্যন্ত তৈরি করা হয়নি। অথচ বিশ্ব ইতিহাসে আন্দোলনের তালিকায় আমাদের ভাষা আন্দোলন অনন্য এক স্থান অধিকার করে আছে।
মায়ের ভাষা একটি মৌলিক অধিকার। এই ভাষা নিজ পরিচয় বহন করে। ঠিক সে কারণেই বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য আন্দোলনের জোরালো দাবি উঠে এসেছিল গণমানুষের মাঝে।
মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই এই বাংলাদেশের একক এবং অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। এখন এই ইতিহাস জানতে হলে তখনকার পত্রিকা বা বই ছাড়া তেমন কোনো সুনির্মিত আর্কাইভ চোখে পড়ে না।
ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। বছরের পর বছর পার হয়ে এই মাস যখন আমাদের সামনে আসে ঠিক তখনই বারবার উচ্চারিত হতে থাকে এই অবিস্মরণীয় ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহীদ বা ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা কেন করা হয়নি। তৎকালীন দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলন চলাকালীন সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হলেও তারা সবাই স্বীকৃতিও পাননি।
ভাষা শহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন—আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। ২০০০ সালে তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে।
বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। তারা তিনজন নিহত হন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম এবং হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রাণ হারানোর তালিকায় আরও দুটি নাম পাওয়া যায়—অহিউল্লাহ ও আবদুল আউয়াল।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের ওয়েবসাইটে ভাষা শহীদ হিসেবে এই দুজনের নাম-পরিচয় উল্লেখ আছে। এছাড়া সালাউদ্দীন নামেও একজন ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু একুশের শহীদ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি মেলেনি। আর এ কারণে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত পাঁচজনই ভাষা শহীদ হিসেবে সমাদৃত হয়ে থাকেন।
কমিটি জানায়, মূলত দুটি বিষয় মাথায় রেখে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। একটি হচ্ছে, যারা ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, অর্থাৎ যারা ভাষা সংগঠক। অপরটি হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের কারণে যারা কারাবরণ করেছেন...
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পত্রিকা ‘সৈনিক’-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। সেখানে উল্লেখ করা হয়, মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ বৃহস্পতিবারেই ৭ জন নিহত: ৩ শতাধিক আহত। তাছাড়া সে সময়ে দৈনিক আজাদের সূত্রমতে, ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।
ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’; আবার অন্য একটি সংবাদে ‘পুলিশের গুলিতে গতকল্য ও অদ্য এ যাবৎ ৬ জন নিহত হয়’ উল্লেখ করা হয়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক) আশেপাশে, নবাবপুর রোড ও বংশাল রোডে গুলিতে কতজন মারা গেছেন, তার সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। আহমদ রফিক তার ‘একুশ থেকে একাত্তর’ নামের বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন।
তথ্য সূত্রে আরও জানা যায় যে, বাংলা ভাষার গৌরবের আন্দোলনে সম্পৃক্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি এক বছর পরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়া ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করেছিল।
তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে কিছু বিতর্কিত নাম থাকায় নতুন বিতর্কের জন্ম দেয় এবং এই অভিযোগের কারণে তালিকা প্রণয়ের কাজটি স্থগিত করা হয়।
সবচেয়ে বড় কষ্টদায়ক বিষয় হচ্ছে, গত ৭০ বছরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় সাক্ষ্য দেওয়ার মতো মানুষগুলোকে আমরা কালের স্রোতে হারিয়ে ফেলেছি...
পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সকল জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। শুরুতেই জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করতে আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয়।
কমিটি জানায়, মূলত দুটি বিষয় মাথায় রেখে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। একটি হচ্ছে, যারা ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন, অর্থাৎ যারা ভাষা সংগঠক। অপরটি হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের কারণে যারা কারাবরণ করেছেন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাষাসৈনিক আহমদ রফিককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল শুধু ঢাকায়। কমিটিতে আরও ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
কিন্তু সেই কমিটির মাত্র একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে কাজের পদ্ধতির জটিলতা নিয়েই শুধু আলোচনা হয়। এরপর থেকে তালিকা প্রণয়নে কাজটি কার্যত বন্ধ রয়েছে।
যদিও তাদের ভাষ্যমতে, ভাষা আন্দোলনও একটি গণআন্দোলনের সামিল হওয়ায় সঠিক ভাষাসৈনিকের তালিকা করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তখনকার কারো কাছে তেমন তালিকা না থাকায় নাম সংরক্ষণ করা হয়নি। যারা সামনের সারিতে থেকেছেন, জোরালো ভূমিকা রেখেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং শহীদ হয়েছেন শুধুমাত্র তাদের তালিকা করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
কোনো বিশেষ কারণে এই কমিটি কাজগুলো করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং এই কারণে নতুন কমিটি করার দাবি থাকলেও তা আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। সবচেয়ে বড় কষ্টদায়ক বিষয় হচ্ছে, গত ৭০ বছরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় সাক্ষ্য দেওয়ার মতো মানুষগুলোকে আমরা কালের স্রোতে হারিয়ে ফেলেছি। সঠিক তথ্য, সূত্র বা স্থান কাল জানার জন্য যাদের কথা আর্কাইভ করার কথা ছিল, তারা আমাদের ছেড়ে পৃথিবীর স্বাভাবিক গতিতে সময়ের অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে যাচ্ছেন।
আমরাই বোধ করি একমাত্র জাতি যে, নিজ রক্তে পাওয়া স্বাধীন ভূমিকে শ্রদ্ধা করতে কার্পণ্য করি। নিজ গর্ব, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস সংরক্ষণ করতে আলসেমি করি। অন্যের উপর দোষ চাপাতে চাপাতে নিজ পরিচয়, অস্তিত্ব এবং অহমকে চাপা দিয়ে পথ চলি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার আলোর গতিকে স্থিমিত করতে করতে অন্ধকারে ডুবে যেতে পছন্দ করি।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা