ধর্ম বিতর্ক : যে যেখানে লড়ে যায়, আমাদেরই লড়া
তিনি পরিপূর্ণ জীবন পেয়েছিলেন। তারপরও ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে ৯২ বছর বয়সে কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যু শোকের চাদরে ঢেকে দেয় গোটা উপমহাদেশকে। বিকেলে মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হয় লতা মঙ্গেশকরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ভারতের ভিআইপি এবং সেলিব্রেটিদের ভিড় ছিল শিবাজি পার্কে।
এই শোকাচ্ছন্ন পরিবেশেই একটি ছবি স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। লতা মঙ্গেশকরের মরদেহের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছেন শাহরুখ খান। পাশে তার ম্যানেজার পূজা দাদলানি। শাহরুখ খান মুসলিম রীতিতে মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে প্রার্থনা করছেন। আর পূজা হিন্দুরীতি অনুযায়ী হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে প্রার্থনা করছেন। মুহূর্তেই তাদের দু’জনের প্রার্থনার ভঙ্গির স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
অনেকেই একে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ছবি হিসেবে অভিহিত করে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দেন। সত্যি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জন ভিন্নধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম মতে প্রার্থনা করছেন, এটা মন ভালো করে দেওয়ার মতো ছবি। যেখানেই হোক, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অনন্য এক ছবি হয়ে ওঠে এটি। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার এমন চমৎকার ছবি পছন্দ হবে কেন সাম্প্রদায়িক বিজেপির।
সাম্প্রদায়িক মুসলমানরাও শাহরুখ খানের ওপর চড়াও হলেন। সেই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বাংলাদশেও ছড়িয়ে পড়ে। লতা মঙ্গেশকরকে বিধর্মী হিসেবে অভিহিত করে তারা বলছেন, একজন বিধর্মীর মরদেহে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে শাহরুখ ইসলামের অবমাননা করেছে।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা এই দুধের নহরে এক ফোটা চনা ঢেলে দেন বিজেপি নেতা অরুণ যাদব। প্রার্থনার যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে অরুণ যাদব তার ভিডিও শেয়ার করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, প্রার্থনা শেষে শাহরুখ খান মুখের মাস্কটি একটু সরিয়ে লতা মঙ্গেশকরের মরদেহের দিকে ফুঁ দিচ্ছেন। অরুণ যাদব সেই ভিডিও শেয়ার করে লেখেন, ‘শাহরুখ কি থুতু ছিটাচ্ছেন?’ ব্যস আর যায় কোথায়।
ধর্মনিরপেক্ষতার ছবিটি যাদের পছন্দ নয়, যাদের মগজের কোষে কোষে সাম্প্রদায়িকতার আবর্জনা; তারা এবার মাঠে নেমে পড়েন। ধর্মনিরপেক্ষতার দুধের নহর দ্রুতই বদলে গেল ঘৃণার চনায়। শুরু হয়ে গেল, শাহরুখ খানের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারের মহড়া। কিন্তু যারা ঘৃণা, বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছিল; তারা আসলে নিজেদের অজ্ঞতারই জানান দিচ্ছিল।
ইসলাম ধর্মমতে, দোয়া করে ফুঁ দেওয়া হয়, যাতে অশুভ শক্তি দূর হয়ে যায়। এখনো বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার মা আমাকে দোয়া করে আমাকে ফুঁ দিয়ে দেন। ইসলাম ধর্মের এই রীতিটুকু না জেনেই বিজেপির সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাঠে নেমে যায়। এমনকি শাহরুখ খান অভিনীত ‘মাই নেম ইজ খান’ সিনেমাতেও দোয়া করে ফুঁ দেওয়ার ধর্মীয় রীতিটি দেখানো হয়েছে।
ভারতে নয়, পাকিস্তানের তো জন্মই হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর প্রবণতা সর্বত্রই বিরাজমান।
অরুণ যাদবরা হয়তো সেই সিনেমাও দেখেননি। তবে সাম্প্রদায়িকতা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নয়, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও আছে। সাম্প্রদায়িক মুসলমানরাও শাহরুখ খানের ওপর চড়াও হলেন। সেই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বাংলাদশেও ছড়িয়ে পড়ে। লতা মঙ্গেশকরকে বিধর্মী হিসেবে অভিহিত করে তারা বলছেন, একজন বিধর্মীর মরদেহে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে শাহরুখ ইসলামের অবমাননা করেছে।
আমি খালি ভেবে অবাক হই, ধর্ম মানুষকে কতটা সংকীর্ণ করে তুলতে পারে। তবে আনন্দের কথা হলো, ভারতের অনেক মানুষ এবং অনেক সেলিব্রেটি শাহরুখ খানের পক্ষেও দাঁড়িয়েছেন, অবস্থান নিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।
শাহরুখ খান বিতর্কে যখন তোলপাড় ভূ-ভারতে, তখন দু’দিনের মধ্যে সব মনোযোগ নিজের দিকে কেড়ে নিলেন আরেক খান- মুসকান খান।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে মুসলমান ছাত্রীদের বোরখা ও হিজাব পরা নিয়ে বিতর্ক চলছিল ক’দিন ধরেই। হিজাবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিল বিজেপি সমর্থক তরুণেরা। এই পরিস্থিতিতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মুসকান খান নিজেকে বোরখায় আবৃত করে স্কুটি নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে আসেন।
তিনি দৃঢ়পায়ে হেঁটে যান। উন্মত্ত একদল সাম্প্রদায়িক তরুণ গেরুয়া স্কার্ফ নেড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিচ্ছিল। মুসকান খান সাহস নিয়ে সেই উন্মত্ত তরুণদের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেয়। অবশ্য শিক্ষকরা দ্রুতই তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়। তবে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ভাইরাল হয়ে যায় মুসকান খানের ‘আল্লাহু আকবর’। একা একজন নারীর এই সাহসী প্রতিবাদ সাহসী করে আরও অনেককে।
চির উন্নত মম শির মুসকান এখন সাহসের প্রতীক। এখানেও অনেকে ধর্মকে টেনে আনতে চাইছেন। ভারতের একটি ধর্মীয় সংগঠন মুসকানের জন্য ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। ‘জয় শ্রীরাম’এর বিপরীতে অনেকে ‘আল্লাহু আকবার’কেও সাম্প্রদায়িক স্লোগান বলে অভিহিত করতে চাইছেন। কিন্তু মুসকানের সাহসিকতা আর প্রতিবাদ ধর্মের অনেক ঊর্ধ্বে।
আমার মনে পড়ে গেল, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবের কথা। হেফাজতের সহিংস কর্মীরা সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনকে প্রকাশ্য রাজপথে হেনস্থা করেছিল।
বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে ধর্মের সিঁড়ি বেয়ে, টিকেও আছে ধর্মকে অবলম্বন করেই। অনেকেই বলছেন, ১০ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখেই বিজেপি আবার সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিতে চাইছে। তাই তো তারা কখনো শাহরুখ খান, কখনো হিজাব বিতর্ককে সামনে আনতে চাইছেন। কিন্তু আমার ধারণা দুই ইস্যুতেই তারা হেরে গেছে।
শুধু ভারতে নয়, পাকিস্তানের তো জন্মই হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর প্রবণতা সর্বত্রই বিরাজমান।
মুসকান খানের একা প্রতিবাদ দেখে আমি একইসঙ্গে অনুপ্রাণিত ও শঙ্কিত হয়েছি। বাংলাদেশে যদি এসব ঘটনা ঘটতো, তাহলে মুসকানের পরিণতি কী হতে পারতো? আমার মনে পড়ে গেল, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবের কথা। হেফাজতের সহিংস কর্মীরা সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনকে প্রকাশ্য রাজপথে হেনস্থা করেছিল।
মুসকান খানের প্রতিবাদকেও অনেকে সাম্প্রদায়িক আবরণ দেওয়ার চেষ্টা করছেন বটে; তবে ইস্যুটা ধর্মের নয়, ব্যক্তি স্বাধীনতার। মুসকান হিজাব পরবেন কি পরবেন না; এটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। হিজাব পরতে কাউকে বাধ্য করা যেমন অন্যায়, হিজাব পরতে বাধা দেওয়াটাও সমান অন্যায়। আর যেখানেই অন্যায় হবে, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। যে যেখানে লড়ে যায়, আমাদেরই লড়া। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে মুসকানের মতো আরও অনেক সাহসী মানুষ লাগবে আমাদের।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ