পুষ্পা কেন এত জনপ্রিয়?
করোনা মহামারির জন্য ভারতসহ পৃথিবীর প্রায় সব চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাগৃহগুলো একপ্রকার বন্ধই বলা চলে। মাঝে মধ্যে লকডাউন বা অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও সিনেমার নামীদামি প্রযোজকরা বড় অঙ্কের টাকা লগ্নি করতে সাহস দেখাচ্ছেন না। দুনিয়ার চলচ্চিত্র শিল্পে স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু হলেও তা অনেকটা ওটিটি নির্ভর।
একসময় সপরিবারে হলে গিয়ে এক উৎসবমুখর পরিসরে সিনেমা দেখার যে সংস্কৃতি সেটি প্রায় বিলুপ্তের পথে। এই আবহের মধ্যেই দক্ষিণ ভারতীয় একটি সিনেমা পুষ্পা: দ্য রাইজ সারা দুনিয়ার হিন্দি প্রিয় বলয়ের দর্শকদের মধ্যে হইচই ফেলে দিয়েছে। বিস্তর আলোচনা বা লেখালেখিও চলছে। বাংলাদেশকেও এর থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। আসলে চলতি ভাষায় বললে এটি একদমই গতানুগতিক মাসালা বা চটকদার মার্কা নিয়ে বানানোর মধ্যে কিছু ভিন্নতা কিন্তু সিনেমাকে সুপারহিট করে দিয়েছে।
গানের কথা, চিত্রণের ধরণ, নৃত্যশৈলী, অভিনয়, প্রেক্ষাপট, মারপিট দৃশ্যের ভিন্নতা, আল্লু অর্জুনের লুক বা চরিত্তিক বৈশিষ্ট্য তো আছেই তার মধ্যে গল্পটি একটি বিশেষ শ্রেণির গাছ রক্তচন্দনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমরা যদি একটি সাধারণ বলিউডি ব্লকবাস্টার কল্পনা করি তাহলে এখানেও তাই দেখব।
প্রতিযোগিতামূলক গল্প বলা এবং প্রশংসনীয় স্টার কাস্টের সাথে প্রায় দুই পর্বের চলচ্চিত্র সিরিজের প্রথম কিস্তি পুষ্পা: দ্য রাইজ। যুক্তিতর্ক ভুলে গিয়ে দক্ষিণী সুপারস্টার আল্লু অর্জুন অভিনীত একটি মূলধারার থিয়েটার পাওয়ার হাউস হিসেবে যোগ্যতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট স্টার পাওয়ার এবং মাসালা রয়েছে বলেই দর্শক অতটা হুড়মুড়িয়ে পড়েছে। আনন্দ নিয়ে সিনেমাটি দেখছে।
দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর ২০২১-এ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া তেলেগু এই ফিল্মটির বিশালতা এতটাই শক্তিশালী যে, এটি শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই থামছে না বরং স্পাইডার-ম্যান: নো ওয়ে হোম, মার্ভেলের লিগ্যাসি ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো দর্শকদের মনে উল্লেখযোগ্যভাবে দাগ কাটতে সক্ষম হচ্ছে, বিশেষ করে, জানুয়ারি ২০২২-এ যখন ছবিটির হিন্দি সংস্করণ অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায় তখন এর সাফল্য ওটিটিতেও ছড়িয়ে পড়ে।
সিনেমাটি গল্পে তার নায়কের উত্থানের ঘটনা বর্ণনা করে — যেখানে ভারতের দক্ষিণী সুপারস্টার আল্লু অর্জুনকে শিরোনাম চরিত্রে দেখা যায়, যখন তিনি কুলি থেকে লালচন্দনের একটি চোরাচালান সিন্ডিকেটের প্রধান হয়ে ওঠেন। অন্ধ্রপ্রদেশের রায়ালসীমা অঞ্চলের শেষাচলম পাহাড়ের বনাঞ্চলে একচেটিয়াভাবে লালচন্দন পাওয়া যায়।
আমরা যদি সিনেমার বাইরে এসে বাস্তবের দিকে নজর দেই তাহলে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে রক্তচন্দনের চাহিদা ব্যাপক। ভারতে রক্তচন্দনের আরেক নাম 'লাল সোনা'। সোনার মতোই মূল্যবান বিরল প্রজাতির এই উদ্ভিদ। আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে এই কাঠের ব্যবহার অধিক। যদিও সিনেমাটির ইন্ট্রোতে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে জাপানের এক বিশেষ মূল্যবান ভায়োলিন তৈরির কথা বলা হয়েছে। এরসাথে জড়িত এক ব্যবসায়ী জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো জাতের রক্তচন্দন কাঠের দাম টনপ্রতি ৭০ লাখ রূপিও উঠতে পারে।
চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং অস্ট্রেলিয়ায় রক্তচন্দন কাঠের বিপুল চাহিদা। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা চীনে। তাই পাচারও বেশি হয় ওই দেশেই। অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলার শেষাচলম জঙ্গলে মেলে এই ব্যয়বহুল রেড স্যান্ডালউড বা রক্তচন্দন।
ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক—এই তিন রাজ্যের সীমান্ত এসে মিলেছে এই ঘন জঙ্গলে। ফলে এখানে চন্দনের চোরাকারবার ঠেকানো প্রশাসনের জন্য দুরূহ। এছাড়া তামিলনাড়ু লাগোয়া অন্ধ্রপ্রদেশের চার জেলা— নেল্লোর, কুর্নুল, চিতোর এবং কাডাপ্পা জেলাতে রক্তচন্দন গাছ মেলে। পূর্বঘাট পর্বতের আবহাওয়ায় এই গাছ খুব ভালো হয়। একেকটি গাছের উচ্চতা ৮-১২ মিটার। দু'ধরনের চন্দনকাঠ পাওয়া যায়। সাদা এবং লাল। সাদা চন্দনে সুঘ্রাণ থাকলেও লাল বা রক্তচন্দনে কোনো গন্ধ নেই। কিন্তু এই কাঠের বিশেষ গুণের জন্য বিশ্বজুড়ে চাহিদা বিপুল। আর সেই চাহিদার কারণেই এই কাঠ পাচার হয়।
ভারতীয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে জব্দ করা রেড স্যান্ডালউডের অর্ধেক নিলামে তুলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার প্রায় এক হাজার কোটি রুপি সংগ্রহ করেছিল। প্রতিবেদনে তামিলনাড়ুর কর্মকর্তাদের বরাতে উল্লেখ করা হয় যে, অন্তত ৪৫০ কোটি টাকার জব্দকৃত চন্দনকাঠ রাজ্যের গোডাউনে পড়ে আছে।
ঘটনা পর্যবেক্ষণে জানা যায়, ২০১৫ সালে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের গভীর জঙ্গলে পুলিশি অভিযানে ২০ চন্দনকাঠ চোরাকারবারি নিহত হয়েছিল। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন অন্ধ্র পুলিশের টাস্কফোর্স গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিল শত শত চোরাকারবারি ও কুলি রক্তচন্দনের বনে জড়ো হয়েছে। তাদের ধরতে টাস্কফোর্স যখন জঙ্গলে হানা দেয়, তখন কুড়াল-ছুরি-পাথর-লাঠিসোঁটা নিয়ে চোরাকারবারিরা পুলিশকে আক্রমণ করলে তারাও পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
ঘটনাটি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে কারণ নিহতরা প্রায় সবাই পাশের রাজ্য তামিলনাড়ুর ইরোড ও ভেলর জেলার বাসিন্দা ছিলেন। আমরা কিন্তু এমনি ঘটনার কিছু অংশ সিনেমাতে দেখি যেখানে পুষ্পা নামের (আল্লু অর্জুন) চরিত্রটি অন্যান্য শ্রমিকদের মধ্যে হিরো হয়ে ওঠে।
সিনেমায় আমরা দেখি পুষ্পা রাজ শেষাচলম গ্রামের অনেক সাধারণ কুলিদের মধ্যে একজন যারা বেআইনিভাবে লাল চন্দনকাঠ কেটে ক্ষমতাবানদের কাছে কিলো দরে বিক্রি করে। স্থানীয় অসংখ্য গুণ্ডাপাণ্ডাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেটের মধ্যে পুষ্পা ধীরে ধীরে তার মেজাজ, নির্ভীকতা ও স্বকীয়তার জন্য মজবুত অবস্থান খুঁজে বের করতে শিখে যাবে এবং ধীরে ধীরে কর্তৃত্ব ও আদেশ প্রদানকারী হয়ে ওঠে এই সিন্ডিকেটের নেতা হয়ে যাবে।
পরিচালক সুকুমারের চলচ্চিত্রের এই নায়ক চরিত্রটিকে একটি করুণ ব্যাকস্টোরিসহ যেকোনো সাধারণ মানুষের মতোই মনে হয়। পুষ্পার সামাজিক কোনো উপাধি না থাকার সাথে তার নিয়মিত সংগ্রামের উপর বারবার জোর দেয় কারণ সে বিবাহবহির্ভূত বন্ধনে নিঃস্ব মায়ের কোলে জন্মগ্রহণ করেছিল। পুষ্পার কাছে একটি সুপার পাওয়ার আছে বলে মনে হয় যাতে সে যেকোনো জটিল পরিস্থিতি থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসে।
আসলে সাধারণ দর্শক কিন্তু নায়কের এই দুটো ব্যাপারকেই খুব উপভোগ করে আসছে বহু বছর। ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, দুই-তিনটি দৃশ্যে তাকে আটকে রাখার জন্য কিছু অতিমাত্রার প্রচেষ্টা রয়েছে বটে কিন্তু তাতে গল্পটা যে আরও চটক হয়েছে। মনে হচ্ছে, নায়ক সর্বব্যাপী, তার সমস্ত প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা সম্পর্কে সে ভালোভাবে সচেতন। এমন কিছু নেই যা তাকে নিচে নামাতে পারে! তার এই উপরে ওঠার টেকনিকগুলো সিনেমাকে শত শত কোটি টাকা ব্যবসার সুযোগ করে দিলো।
প্রায় তিন ঘণ্টার এই চলচ্চিত্রে নায়িকারূপী রাশমিকা মান্দানার শ্রীভল্লীর নামের চরিত্রের কিন্তু একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভূমিকা রয়েছে বটে কিন্তু ধীরে ধীরে, চরিত্রটি ৯০-এর দশকের মাসালা চলচ্চিত্রের একটি 'নায়িকা'-এর টেমপ্লেট অনুসরণ করতে দেখে দর্শক। মান্দানাকে কৃতিত্ব দেওয়ার জন্য, অনেক ভূমিকাই থাকতে পারে, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের আইনকে অস্বীকার করে এমন ক্রিয়া প্রদর্শনের জন্য পুষ্পা রাজের প্রদর্শনী এই একটি কারণ ছাড়া তার করার মতো হয়তো কিছুই ছিল না।
চলচ্চিত্রে নেতৃস্থানীয় নারী চরিত্রদের এই ধরনের অভিক্ষেপ আজকের দিনেও বিদ্যমান যা যুগের বিবর্তনে হয়ে আসছে এবং হয়তো সামনের দিনেও ঘুরেফিরে দেখা যাবে। কিন্তু পুষ্পা: দ্য রাইজ নির্দ্বিধায় এটি তার প্রচারের জন্য নায়কের 'কবজ' হিসেবে ব্যবহার করে তা আর কোনো ভিন্ন মাত্রা যোগ করে না।
তেলেগু জনপ্রিয় অভিনেত্রী সামান্থার একটি ক্যামিও রয়েছে যা প্রায়শই একটি 'আইটেম গান' হিসেবে বর্ণনা করা হয়, এটি একটি মাসালা বিনোদনের গতানুগতিক সস্তা উপায় যা প্রায় সকল মাসালা চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে।
আসলে এটি একটি প্যান-ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রবণতার সফল প্রয়াস, যা প্রায়শই এস.এস. রাজামৌলির মহাকাব্য গাঁথা বাহুবলীকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যদিও এটি রাতারাতি সাফল্যের সূত্র নয় তবে এটি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি বলিউডের প্রযোজক-পরিচালক করণ জোহর যেমন একটি ফিল্ম আড্ডায় উল্লেখ করেছেন, এর "প্রকৃত প্রভাব" স্যাটেলাইট টিভি থেকে এসেছে। হিন্দিতে ডাব করা অনেক দক্ষিণের ছবি বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতীয় বিভিন্ন টেলিভিশনের পর্দায় আকৃষ্ট হয়েছে।
টারজান: দ্য ওয়ান্ডার কার এবং সূর্যবংশমসহ। যে কারণে সম্ভবত, আল্লু অর্জুনের মতো একজন দক্ষিণ মেগাস্টার দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে আনতে বা ওয়েবে তার চলচ্চিত্র দেখতে সক্ষম হচ্ছে, কারণ তিনি বছরের পর বছর ধরে ছোট পর্দা থেকে দর্শকদের প্রলুব্ধ করে আসছেন।
হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজকদের একটি গোলটেবিল আলোচনার সময় করণ জোহর মত দেন, প্যান-ইন্ডিয়া প্রবণতা এমন একটি ঘটনা যা আমরা কমাতে বা অস্বীকার করতে পারি না। শুধু তাই নয়, দক্ষিণের অনেক চলচ্চিত্র সিক্যুয়াল এবং বহু অংশ চলচ্চিত্রের মডেলও অন্বেষণ করছে।
কেজিএফ চ্যাপ্টার ১ (২০১৮), বাহুবলি (২০১৫) এবং বাহুবলি ২ (২০১৭) এর দর্শক জনপ্রিয়তা হলো ক্লাসিক উদাহরণ। পুষ্পা: দ্য রাইজও একটি দুই পর্বের সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র, যেখানে পুষ্পা: দ্য রুল পরবর্তী চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মাণাধীন। অনেকে জানেন হয়তো এটিও দেখতে সিনেমা হলে ভিড় জমাবে লক্ষ কোটি দর্শক। মনের আনন্দে দর্শকের টাকায় ব্যবসা হবে হাজার কোটি। পুষ্পা: দ্য রাইজ এর মতো কিছুদিন দুনিয়া মাতবে হইচইয়ে। আড়ালেই থেকে চলচ্চিত্রের অনেক ভালো কিছু।
নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক