আত্মহত্যা নয়, বেঁচে থাকাই জীবন
নিজেকে নির্মমভাবে হত্যার অপর নাম আত্মহত্যা। এই নির্মমতার প্রভাব অবর্ণনীয়। প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আফসোস করে আমাদের জীবন কেন এত ক্ষণস্থায়ী? এত সুন্দর পৃথিবী, এত সুন্দর জীবন আর জীবনের সাথে সম্পর্কের এত মধুর বন্ধন ছেড়ে কে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চায়? এ প্রশ্নের উত্তর, ‘না’।
প্রিয়জনকে ছেড়ে কেউই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না। পৃথিবীতে এমন একজনও সুস্থ মানুষ পাওয়া যাবে না যে কি না মৃত্যুর কথা মনে করলে আঁতকে ওঠে না। তবু কিসের আশায় মানুষ নিজের জীবনকে নিজেই হত্যা করছে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই সামনে চলে আসে আত্মহত্যার করুণ রূপ!
আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা কেবল প্রিয়জন হারা মানুষগুলো বুঝতে পারে। মৃত্যুর ওপারের জীবন কেমন আমাদের জানার সুযোগ নেই। তাই হয়তো বেঁচে থাকার এপারের জীবনে মানুষ এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয় যে ঘটনায় তার জীবন হয়ে ওঠে অতি তুচ্ছ যা হননে একজন মানুষ জীবনের মহত্ত্ব একটি মুহূর্তের জন্য ভুলে যায়। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি ঘটনা অথবা কয়েকটি ঘটনার সমন্বয় যা রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির।
কী কী কারণে মানুষ বহু সাধ ও সাধনার এই জীবনকে এক নিমেষে হত্যা করে আত্মহত্যাকে একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়? গবেষণা বলছে, আর্থিক সংকট, বেকারত্ব, লেখাপড়ায় বাধা, পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমে ব্যর্থতা, অনুভূতির টানাপোড়েন, পছন্দের বাইরে বিয়ে দেওয়া বা করা, সামাজিক সম্মানহানিসহ নানাবিধ সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ দায়ী একজনের আত্মহত্যার পেছনে।
আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা কেবল প্রিয়জন হারা মানুষগুলো বুঝতে পারে। মৃত্যুর ওপারের জীবন কেমন আমাদের জানার সুযোগ নেই।
এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করে যদি আমরা একটি বিশেষ সূচকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই তাহলে নিশ্চিতভাবেই তা হবে ‘আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা’র অভাব। কারণ, একজন মানুষ যদি রাষ্ট্রের ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’র মধ্যে থাকে তাহলে তার আর্থিক অসচ্ছলতা বা বেকারত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার পড়ে না। আর বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ বা মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া এসবের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী আর্থিক অসচ্ছলতা। এছাড়া, আত্মহত্যার জন্য দায়ী উল্লেখ্য কারণগুলো কখনোই একজন মানুষের বিষণ্নতার কারণ হতে পারে না যদি সে ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’র মধ্যে থাকে।
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার উপর এক সমীক্ষায় পেয়েছে গতবছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬২জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২জন, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪জন এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬৫জন পুরুষ এবং ৩৬জন নারী শিক্ষার্থী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এছাড়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫জন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। কারণের অনুপাতে দেখা যায়, সম্পর্কগত সমস্যার কারণে ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর্থিক সমস্যার কারণে ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ, মাদকাসক্ত হয়ে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করেছেন ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
উন্নত বিশ্ব তথা যেসব দেশে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে কম তাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেসব দেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কত বেশি মজবুত। ওইসব রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা দিতে বদ্ধপরিকর। পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শারীরিক অসুখের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে। এই অসুখের নাম বিষণ্নতা।
রাষ্ট্রকে নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন উপাদান যেমন, পার্ক, খেলার মাঠ, থিয়েটার, পাবলিক লাইব্রেরি ইত্যাদির সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
উন্নত বিশ্বের মানুষ এই মানসিক অসুখকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কাজের জায়গাগুলোতে শিক্ষার্থী বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেকোনো প্রয়োজনে তারা অভিজ্ঞদের কাছে সাহায্য নিয়ে বিষণ্নতা দূর করতে পারে সেটি হতে পারে সাইকোথেরাপি কিংবা কাউন্সিলিং। কিন্তু আমাদের দেশে এই সুবিধাগুলোর একটাও কি নাগরিকরা পাচ্ছে?
রাষ্ট্র না পারছে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, না পারছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার কোনো ব্যবস্থা করতে। উল্টো মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন উপাদান যেমন, পার্ক, খেলার মাঠ, থিয়েটার, পাবলিক লাইব্রেরি ইত্যাদি আজ ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে। আর সাইকোথেরাপির বা কাউন্সিলিং-এর মতো জিনিস তো অনেক দুরূহ। তাহলে কীভাবে আমরা আশা করতে পারি যে এমনি এমনি কোনো দৈবশক্তির কল্যাণে আমাদের দেশে আত্মহত্যার হার কমে যাবে?
তারপরও করোনার ভয়াল থাবার কথা ভুলে গেলে চলবে না। ডিসেম্বর ২০২০-এ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, জাপানে করোনার থেকে আত্মহত্যায় মৃত্যু বেশি। জাপানের ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবরে আত্মঘাতী হয়েছেন মোট ২১৫৩। আবার পুরুষদের তুলনায় আত্মহত্যার পথ বেশি বেছে নিচ্ছেন মহিলারা। শুধু অক্টোবরেই মহিলাদের আত্মঘাতী হওয়ার হার ৮৩% এবং পুরুষদের হার ২২%। একইরকম চিত্র দেখা যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর রিপোর্ট (NCRB) অনুযায়ী দেশটিতে ২০২০ সালে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ১ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক।
এখন আসা যাক, সেই প্রসঙ্গে যা আত্মহত্যার হার কমাতে সহায়ক হবে। প্রথমত, রাষ্ট্রের প্রাণ হিসেবে এর নাগরিকদের ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং একজন শিক্ষার্থী যতদিন বেকার থাকবে তাকে বেকারত্ব ভাতা’র আওতায় আনতে হবে। এছাড়া বেকার জনগোষ্ঠী যেন হেয় প্রতিপন্ন না হয় তার নিমিত্তে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মনে রাখতে হবে, মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে যেন একজন শিক্ষার্থীও অর্থাভাবে ঝরে না পড়ে। বাল্য বিবাহসহ ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ের বিরুদ্ধে কঠোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে, রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যা ইতিমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, আমাদের অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে, আমাদের ইচ্ছে বা জেদের থেকে আমাদের সন্তানের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেন প্রেমে ব্যর্থতার মতো কারণে আর একজন মানুষও আত্মহত্যা না করে।
চতুর্থত, রাষ্ট্রকে নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন উপাদান যেমন, পার্ক, খেলার মাঠ, থিয়েটার, পাবলিক লাইব্রেরি ইত্যাদির সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
পঞ্চমত, বিষণ্নতায় পর্যবসিত হলে মানুষ যেন তা নিজের মধ্যে লুকিয়ে না রেখে অভিজ্ঞদের সাহায্য নেয় তার জন্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে প্রত্যেক সরকারি হাসপাতাল বা কমিউনিটি সেন্টারে অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিশেষে, সময় বদলে গেছে। তার সাথে পাল্টে গেছে আমাদের জীবন ধারা। তাই আমাদের আরও ভাবতে হবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। ইন্টারনেট আসক্তি, সমাজের অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চাকরিজীবী অভিভাবকের সন্তানের জন্য সময় কম দেওয়া, প্রিয়জনের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, ফেসবুকের বিমূর্ত বন্ধুর মাঝে বুদ হয়ে থেকে সামনের বন্ধুকে ভুলে যাওয়া, ভিডিও গেমসের জগতে গিয়ে বিকেলে মাঠের ফুটবলের চল হারিয়ে যাওয়ার মতো কারণগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।
আমাদের বিষণ্ন লাগতেই পারে। এই বিষণ্ন লাগা, হতাশ লাগা এগুলো কোনো বড় ঘটনা নয়। শরীরের রোগের মতো মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন প্রয়াস আরও বাড়াতে হবে। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। সব থেকে বেশি যা দরকার তা হলো, আমাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গাকে মজবুত করতে হবে।
জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মনে রাখতে হবে, মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। আমরা চাই, মানুষ নিজেকে ভালবেসে বেঁচে থাকুক, আত্মহত্যার এই দুঃখগাঁথার ইতি ঘটুক।
শান্তা তাওহিদা ।। চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়