মহাত্মা গান্ধী : অহিংস আন্দোলনের পুরোধা
‘পৃথিবীতে তুমি যে পরিবর্তন দেখতে চাও তা নিজেকে দিয়ে শুরু করো। যেদিন ভালোবাসা, ক্ষমতার লোভকে হরিয়ে দেবে, সেদিন এই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে। চোখের বদলে চোখ, সারা বিশ্বকে অন্ধ করে দেবে।’ -- কথাগুলো বিদ্রোহী কিশোর থেকে ভারতের জাতির জনক হিসেবে সম্মানিত হওয়া সেই মহাত্মা গান্ধীর। পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আজ তার ৭৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসে ব্ল্যাক পয়েন্ট রেঞ্জে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজকীয় প্রাদেশিক এলাকা পোরবন্দরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্ম।
নিরামিষ ভোজন, ধর্মীয় সহনশীলতা, সহজ-সাধারণ জীবন-যাপন এবং অহিংসার পথে চলা- গান্ধী সম্পর্কে এটুকুই বেশি প্রচারিত হয়। কিন্তু তার জীবনের পরিসরটা আসলে এটুকু নয়।
আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান
আজ ভারতবাসী তো বটেই, বাংলাদেশেও তাকে স্মরণ করা হচ্ছে। গান্ধী বিশ্বাস করতেন, এই উপমহাদেশের সমাজ স্বাভাবিক ভাবেই অহিংসার পথে চলতে অভ্যস্ত, তাই তার ওপর ভিত্তি করে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা খুবই সম্ভব। কিন্তু আজকের ভারত, বাংলাদেশ তথা গোটা উপ-মহাদেশ দেখে বোধ করি বলা যায় যে, তিনি এই সমাজকে চিনতে পারেননি।
আমাদের সামাজিক পরিসরের বুননে মহাত্মা গান্ধীর উপস্থিতি এখনও অমোঘ, বিশেষত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রশ্নে তিনি এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। ধর্মনিরপেক্ষতা যা বলে, তা সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর নিজের ধর্ম মেনে চলার সম্পূর্ণ অধিকারের কথা। এটাই ছিল গান্ধীর দর্শন।
নিরামিষ ভোজন, ধর্মীয় সহনশীলতা, সহজ-সাধারণ জীবন-যাপন এবং অহিংসার পথে চলা- গান্ধী সম্পর্কে এটুকুই বেশি প্রচারিত হয়। কিন্তু তার জীবনের পরিসরটা আসলে এটুকু নয়।
তিনি বলেছিলেন, ‘একজন হিন্দুকে মেনে নিতে হবে যে মুসলমানেরা বলবেন আল্লাহ ব্যতীত আর কোনও ঈশ্বর নেই; আবার, সেই মূর্তিপূজাবিরোধী মুসলমানকেও মেনে নিতে হবে যে হিন্দুরা মন্দিরে মূর্তির উপাসনা করবেন’।
পাকিস্তান তো সেই ১৯৪৭-এই সাম্প্রদায়িক শক্তির খপ্পরে পড়েছে, কিন্তু আজকের ভারত-বাংলাদেশেও মহাত্মার এই দর্শন বড়ভাবে অনুপস্থিত। সত্য আর অহিংসা যেখানে ছিল গান্ধীর কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রাজনীতি, তার যাবতীয় বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর, সেটাই আজ সমাজের রাজনীতির।
মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা সব সত্যকে, মানবিকতাকে দূরে ঠেলে এগিয়ে চলেছে দুর্দণ্ড প্রতাপে। তিনি নিজেও ধর্ম বিশ্বাস করতেন, তিনি হিন্দুধর্মে আমূল বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেই বারবার বলেছেন, ধর্মের যে প্রথা তার কাছে যুক্তিগ্রাহ্য নয়, তিনি তা গ্রহণ করিবেন না।
আরও পড়ুন : সূর্যোদয়ের বঙ্গবন্ধু
এই যুক্তি নৈতিকতার ধর্ম, বা ধর্মের নামে প্রচলিত আচারের অন্ধ অনুশীলনের বিপরীত। তার মতে, প্রকৃত ধার্মিক শুধু ভিন্ন ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ সহনশীল নন, সেই ধর্মের মধ্যে যা উত্তম, তা গ্রহণে সদাপ্রস্তুত।
অন্য দিকে, সম্পূর্ণ অহিংসার দর্শন তাকে শিখিয়েছিল সব মানুষের প্রতি সমভাবাপন্ন হতে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তার স্বপ্নের ভারতবর্ষে কোনও একটি ধর্মের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না— সেই ভারতে প্রতিটি ধর্ম সম-অধিকারে একে অপরের সঙ্গে সহাবস্থান করবে।
আজ তার মৃত্যুদিনে কেবলই মনে হয় গান্ধীকে নিয়ে এখনকার ক্ষমতার রাজনীতির বড় অস্বস্তি। উপ-মহাদেশীয় রাজনীতি এবং এর মনন হতে গান্ধীকে মুছে ফেলা না গেলেও তাকে ভুলে থাকার প্রচেষ্টা ভেতরে ভেতরে আছে।
মহাত্মা গান্ধী মানেই চশমা বা খাদির ক্যালেন্ডারে চরকাশোভিত একজন ব্যক্তি নন। মানুষটি ধর্ম বিষয়ে এবং পরধর্ম বিষয়ে, ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্ব বিষয়ে এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বিষয়ে যা যা বলে গেছেন বা লিখে গেছেন সেগুলোর প্রতিটি অক্ষর সাম্প্রদায়িকতা-ভিত্তিক এখনকার রাজনীতির বিপ্রতীপ।
বাংলাদেশে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের প্রাক্কালে মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তার এই ডাক আন্দোলনকে নতুন মাত্রা ও ব্যাপ্তি প্রদান করেছিল, যা বাংলাদেশে পাকিস্তানের ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্র সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছিল।
মহাত্মা গান্ধীর শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং শান্তি ও মানবতার আন্দোলনের নেতাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
বাংলাদেশে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের প্রাক্কালে মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তার এই ডাক আন্দোলনকে নতুন মাত্রা ও ব্যাপ্তি প্রদান করেছিল, যা বাংলাদেশে পাকিস্তানের ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্র সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অপরাজেয় কথাশিল্পী
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অবিস্মরণীয় নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামের প্রধান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাদের আন্দোলন ও সংগ্রামে গান্ধীর আদর্শিক প্রেরণার কথা স্বীকার করেছেন।
গান্ধী তার প্রথম জীবনের ২০ বছর কাটিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, যেখানে তিনি আইন পেশার পাশাপাশি ব্রিটিশ শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার ও মর্যাদার জন্য আন্দোলন করেছেন।
১৯১৩ সালে স্বদেশে ফিরে আসেন গান্ধী। যোগ দেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে। তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুই ধারায় বিভক্ত ছিল। বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে কংগ্রেসে এবং কংগ্রেসের বাইরেও সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী চরমপন্থি ধারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু গান্ধী চরমপন্থায় বিশ্বাস করতেন না। হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদেও বিশ্বাস করতেন না। তিনি সব ধর্মের সমন্বয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন।
ভারতবর্ষের সব ধর্মের অনুসারী, বিশেষভাবে দুই প্রধান ধর্মের অনুসারী হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন গান্ধী। সাদায়িক দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করবার জন্য তিনি বার বার অনশন করে মানুষের শুভচেতনা জাগ্রত করতে চেয়েছেন। আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য তিনি সর্বধর্মীয় প্রার্থনার প্রচলন করেছিলেন ভারতবর্ষে।
সভ্যতার ধারাবাহিকতায় বহু মহাপুরুষ মানবপ্রজাতিকে হিংসা, সংঘাত ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করার জন্য বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী আমাদের জন্য বিশেষভাবে পাথেয়। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতাকে পরাজিত করতে হলে মহাত্মার মতো আত্মশুদ্ধি এবং পরমতসহিষ্ণুতার পথে হাঁটতে হবে রাজনীতিকে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন