আইনের শাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পিতার স্বপ্ন
সামাজিক ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা সংরক্ষণের তাগিদে আমরা ন্যায়বিচার শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি। পৃথিবীর আদিকাল থেকে এক সময় যা ন্যায়বিচার বলে বিবেচনা করা হয়, তা হয়তো অন্য সময়ে একইভাবে বিবেচনা নাও হতে পারে। সেকারণে ন্যায়বিচার শব্দের আপেক্ষিকতা স্থান, কাল ও সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, ‘যে ব্যক্তি দেশের আইন লঙ্ঘন করে অথবা তার যা প্রাপ্য তারচেয়ে বেশি গ্রহণ করে, সে অন্যায়কারী অথবা ন্যায়বিচার বিরোধী।’ উল্লেখিত গুণাবলী নিয়ে কোনো মানুষ ন্যায়বিচারের ধারণা করতে পারে না। অবিচার থেকে ন্যায়বিচারের প্রয়োজন সহজে অনুভব করা যায়।
বিভাগ পূর্ব তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যাবতীয় প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করতো। ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর নিকট রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করার অবকাশ ছিল না, তখন ন্যায়বিচারের অর্থ ছিল রাজঅনুগ্রহ।
সাধারণ মানুষ অনন্যোপায়। ‘নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে, দরিদ্রের ভগবানে বারে ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে, মরে সে নীরবে;’ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং শাসকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করার কোনো উপায় নেই।
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের জালিয়ান ওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার কে করবে? ‘আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে হেনেছে নিঃসহায়ে, আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’
১৯৪৭ সালে বিদেশি শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে তৎকালীন ভারতবর্ষ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। উভয় দেশের সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করা হয়। আদালতের আইন কানুন ও ন্যায়বিচার করার অধিকার কোনো প্রকার ক্ষুণ্ন করা হবে না।
ভারতে অবশ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। জে, কে, আয়রন ইউনিয়ন কোং বনাম মজদুর ইউনিয়ন (AIR 1956SC 231) এর মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, কেবল মাত্র নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অথবা কর্মচারীগণের ও নিম্নআদালত সমূহের যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতিরোধ করাই নয়, আইন পরিষদ সমূহের তথা পার্লামেন্টেরও যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতিরোধ করার কর্তৃত্ব এই আদালতের উপর সংবিধান ন্যস্ত করেছে।
আইন পদ্ধতির মৌলিক বিধি উপেক্ষা করে কোনো ব্যক্তিকে তার জানমাল ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যায় না। যে আইন পদ্ধতিতে ন্যায়পরায়ণরার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বিধি অনুস্মরণের নিশ্চয়তা থাকে না তা থেকে নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষিত হয় না। নির্বাহী কর্তৃপক্ষ ও আইন পরিষদের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপে প্রতিরোধকল্পে সংবিধানে ন্যায়বিচারের বিধান করা হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মের পর ১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর আমাদের মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্যে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ Further pledging that it shall be a fundamental aim of the State to realise through the democratic process a socialist society, free from exploitation a society in which the rule of law, fundamental human rights and freedom, equality and justice, political, economic and social, will be secured for all citizens যা ঐ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের শাসনের মূল দর্শন হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে।
২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। All citizens are equal before law and are entitled to equal protection of law.
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং বাংলাদেশের ন্যায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে আইনানুগ ন্যায়বিচার মূল দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, আইন পরিষদ ও নিম্ন আদালত সমূহের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ থেকে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মর্যাদা রক্ষার এটাই একমাত্র রক্ষাকবচ।
মানুষের জন্যেই সরকার, মানুষ সরকারের জন্যে নয়, এই মতবাদ থেকে আইনানুগ ন্যায়বিচার নীতি জন্ম লাভ করেছে। এই নীতি অনুসারে জনগণ নির্দিষ্ট আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আগে রাশিয়া, চীন ও স্পেনের ন্যায় একদলীয় শাসন পদ্ধতিতে আইনানুগ ন্যায়বিচার কল্পনা করা যেত না। সামরিক শাসনেও এরূপ অবস্থার অবতারণা হয় যা সুশাসন ও ন্যায়বিচারের দর্শনে গ্রহণযোগ্য নয়।
একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যে (১) আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (Due process of Law), (২) আইনের শাসন (Rule of Law), (৩) আইনের বিধি বহির্ভূত কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা (Save in accordance with law), (8) শুনানির সুযোগ দান ব্যতীত দণ্ড দান না করা (Audi Alteram Partem), (৫) কেউ নিজের বিচারক নিজে হতে পারে না (No person can be a judge of his own cause), (৬) সার্বভৌম কোনো অন্যায় করতে পারে না (King Can do no wrong), (৭) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আদালতের সহজাত এখতিয়ার (Inherent Jurisdiction), (৮) ন্যায়পরতা ও বিচক্ষণতা (equity and expediency) (৯) পুনরায় বিবেচনা (Review), (১০) দায় অব্যাহতি বিধি (Immunity) অনুস্বরণ করা হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বিশ্বের সেরা সংবিধান বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন, উক্ত সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার ওয়াদা করা হয়েছে, ‘আইন অনুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবেই না।’ (No person shall be deprived of life or personal liberty save in accordance with law.) এখনো আমাদের সংবিধানে বলবৎ আছে।
বিচারকের নিরপেক্ষ ভূমিকা যেমন ন্যায় বিচারের জন্যে অতীব প্রয়োজনীয়, তেমনি বিচারকের রায় আইনসম্মত পদ্ধতিতে গৃহীত হয়েছে বলেও প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক। প্রতিহিংসা কিংবা পক্ষপাতিত্ব যেন বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বিনষ্ট না করে। ‘দণ্ডের সাথে দণ্ড দাতা কাঁদে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’
মানুষ যুক্তিনির্ভর সামাজিক জীব। সমাজের সহস্র বাধার মাঝে সে মুক্তির স্বাদ লাভ করতে চায়। ভয়-ভীতি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে জানমালের নিরাপত্তার জন্যে, জীবনে পূর্ণতা লাভের জন্যে সমাজ গড়ে ওঠে।
পারস্পরিক সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্যে মানুষের সামাজিক চেতনা ও দর্শন বিভিন্ন রূপে অভিব্যক্ত হয়। তবে সকল সমাজে একটি অভিন্ন দর্শন আছে, দুঃখ-দৈন্য পরিহার করে সুখ-শান্তি-সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি সাধনের জন্যে নিরলস প্রচেষ্টা।
এই ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত হতে প্রত্যেক ব্যক্তির আচরণ সমাজের কথিত মূল দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই আচরণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল অবলম্বন ব্যতীত একটি সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা, সভ্যতার অস্তিত্ব, সমাজে কল্পনা করা যায় না। সর্বকালে সকল সমাজে তাই একটি যুক্তিসঙ্গত আচরণবিধি উদ্ভাবন ও কার্যকর করার নিরলস প্রয়াস এখনো লক্ষ্য করা যায়।
জনকল্যাণকামী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা পরিকল্পনার জন্য ন্যায় বিচারের উদ্দেশে মানুষের আচরণের জন্যে একটি নির্দিষ্ট আদর্শে স্থানীয় বিধি থাকা বাঞ্ছনীয়। সমাজের সকলেই উহা অনুস্মরণ করবে অথবা সামাজিক শক্তিবলে উহা পালন করতে বাধ্য করা হবে। সীমা লঙ্ঘনকারীকে অবশ্যই দণ্ড দেওয়া হবে।
দণ্ডের ভয়ে দুর্বৃত্ত ও দুষ্ট লোকেরা আইন ভঙ্গ করতে সাহসী হবে না। আইন ভঙ্গের জন্যে স্ব-মহিমায় আইন উচ্চারিত হবে, আইন ভঙ্গের দায় নির্ধারণ ও দণ্ডদানের জন্যে সমাজ ব্যবস্থায় বিচার প্রশাসন পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়। আগে থেকে বিভিন্ন সমাজের দর্শনের আলোকে বিচার প্রশাসন পদ্ধতির প্রচলন চলমান আছে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।
মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ।। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি