উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান : পাকিস্তানি আন্দোলন ও বর্তমান রাজনীতি
পাকিস্তানের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে ১৯৬৯ এর ২৪ মার্চ এদেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা দখলে নেয়। জনতা জীবন দিয়ে আইয়ুব খানের মতো 'লৌহ মানব'কে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কারখানার শ্রমিক, গ্রামের কৃষক, দোকানদার, অফিসের কর্মচারী আর শহরের মধ্যবিত্ত নারী পুরুষ, ছাত্র-যুব, শ্রমজীবী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এই আন্দোলনের ব্যাপকতা, তীব্রতা, অতীতের সব আন্দোলনকে ছাড়িয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করে।
দীর্ঘ পথে বিক্ষোভ মিছিল করে আদমজী, লতিফ বাওয়ানি জুট মিলের হাজার হাজার শ্রমিক আর গ্রামের কৃষকদের রাজধানীতে আসার অনন্য ঘটনাটা এখনকার তরুণদের কাছে গল্পের মতো মনে হতে পারে। এই আন্দোলনে মানুষের লাগাতার অংশগ্রহণ, মানুষের ক্ষমতার বিস্ফোরণ আর সাফল্য একে 'গণঅভ্যুত্থান' হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং স্বীকৃতি দেয়।
স্বাধীনতার ঘোষণায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা সুনির্দিষ্ট করা হয়। বিজয়ী দেশে ১৯৭২ সালে সংবিধানের চার মূলনীতি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের কথা স্পষ্ট করা হয়।
ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘ সময়ে এ ধরনের ঘটনা আগে আর ঘটেনি। পাকিস্তানি স্বৈরশাসন বিরোধী কয়েক বছর ধরে লাগাতার আন্দোলনের ফয়সালা হয়েছিল এই গণঅভ্যুত্থানে। এর মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
দেশবাসীর রায় ছিল, গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। ১৯৭০-এর নির্বাচনেও মানুষ গণরায় দিয়েছিল। তারপরও পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। জনগণের এই রায় বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে ১৯৭১-এ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর ১৯৪৮ সালেই গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন শুরু করতে হয়েছিল। ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাত রুখে দাঁড়াতে ১৯৫২-এর ভাষা সংগ্রামে জীবন দিয়ে জিততে হয়েছিল। এই তৎপরতায় জাতীয় চেতনার অনন্য বিকাশ সাধিত হয়েছিল।
এই পথ ধরে ১৯৫৪-এ যুক্তফ্রন্ট ২১ দফায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। এতে পাকিস্তানি শাসকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। এরপর শাসকরা দমন পীড়নের মাত্রা তীব্র করেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ৬ দফা, ১১ দফার সংগ্রামকে সামনে রেখে সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে যেতে হয় মুক্তিযুদ্ধে।
৬ দফা ও ১১ দফায়, স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের দাবি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানের কথা স্পষ্ট হয়ে সামনে চলে আসে।
স্বাধীনতার ঘোষণায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা সুনির্দিষ্ট করা হয়। বিজয়ী দেশে ১৯৭২ সালে সংবিধানের চার মূলনীতি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের কথা স্পষ্ট করা হয়।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তানের শাসকদের ভিত্তি কাঁপিয়েছিল। একই সাথে সচেতন তরুণ রাজনৈতিক নেতাকর্মী আর সচেতন মানুষকে, মানুষের স্বার্থে নিবেদিত হয়ে কাজ করার উৎসাহ জুগিয়েছিল।
এই স্বাধীন দেশেও স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ ৯ বছরের (১৯৮২-১৯৯০) সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হয়েছিল আরেক গণঅভ্যুত্থানে। ঐ দীর্ঘ লড়াইয়ে বিভিন্ন শ্রমজীবী, ছাত্র-জনতা নিজস্ব দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
মানুষ জীবন দিয়ে লড়াই করেছিল। মানুষের মধ্যে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। এই অভ্যুত্থানের পটভূমিতে রাজনৈতিক জোটের ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা, আচরণ বিধি ছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
কথা ছিল, প্রতিষ্ঠা হবে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার রাজনীতি। দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে পরিচালিত হবে রাজনীতি। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এটাকে আরও জাগ্রত করে। অথচ আজ সাধারণ মানুষ চলতি ধারার রাজনীতিতে নিজেকে খুঁজে পায় না। সাধারণ মানুষের স্বার্থের রাজনীতির ধারা এখনো জাতীয় ভাবে সাধারণ মানুষের ভরসার স্থলে পরিণত হয়নি।
যে মুক্ত স্বাধীন জীবনের আকাঙ্ক্ষা মানুষ জন্ম থেকে পোষণ করে, গণতন্ত্রকে সামনে রেখে এটি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে-ঐ 'গণতন্ত্র'-কে মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে থেকে, প্রধানত শাসক-শোষকদের কাছ থেকে উদ্ধার করা যায়নি। ন্যূনতম ভোটের অধিকার, মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশে শাসনের স্বীকৃতি থাকলেও এটা কাগজে বন্দি। এসব কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে মানুষের উন্নত সংস্কৃতি ও মানবিক চেতনা গড়ে তোলার পথ কর্তৃত্ববাদী শাসকদের হাতে বন্দি।
এই সামগ্রিক কাজ অগ্রসর করতে জনগণের শাসন, সুশাসন এর দেখা মেলে না। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সৃষ্ট এসব
গণআন্দোলনে সাময়িক সময়ে সাধারণ মানুষের গুণকীর্তন থাকলেও, এর সুফল শাসক গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থ হারিয়ে যায়।
গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি না থাকায়, গড়ে না ওঠায় অনেক সময় ঐ ধারা রক্ষা করে এগোনো যায় না। তবে ঐ ধারায় গড়ে ওঠা সংগ্রামী চেতনা বৃথা যায় না। ঐ ধারার পথ ধরে নতুন পথ রচনায় মানুষ এগিয়ে যায়।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তানের শাসকদের ভিত্তি কাঁপিয়েছিল। একই সাথে সচেতন তরুণ রাজনৈতিক নেতাকর্মী আর সচেতন মানুষকে, মানুষের স্বার্থে নিবেদিত হয়ে কাজ করার উৎসাহ জুগিয়েছিল।
ঐ গণঅভ্যুত্থানে জড়িত ছাত্র, তরুণ, শ্রমজীবী সংগঠকরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছেন, মানুষকে তার স্বার্থের লড়াই করতে সচেতন ও সংগঠিত করেছেন। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে গিয়ে তাদের স্বার্থের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অগ্রসর জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছেন।
এই ধারা আজও আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে। এই ধারাকে অগ্রসর করার মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
শহীদের ও গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জনগণের সচেতন ও সংগঠিত অংশগ্রহণে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করেই ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
রুহিন হোসেন প্রিন্স।। সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)