প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক
১
আমাদের আছে অজস্র হারিয়ে ফেলার গল্প এবং তাতে আমরা শুধু বিচলিতই হই। আমাদের হারিয়ে যায় গান, টিভি নাটক, যাত্রা, সার্কাস, মঞ্চ নাটক, কিংবা এরকম অনেক সামাজিক বিনোদন মাধ্যম। যার ভেতর দিয়ে মানুষে মানুষে যে রুচির সংযোগ ঘটে যেন তার প্রায় সবকিছুই আমরা হারিয়ে ফেলি। যদিও আমার লেখার বিষয় শুধু টেলিভিশন নাটক কিন্তু আমি হয়তো বার বার অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় চলে যাবো। কারণ আমি আলোচ্য বিষয়টি তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে লেখার চেষ্টা করবো না, বরং সময়ের আবেগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবো।
একটা সময়ে আমাদের টেলিভিশন নাটক হয়েছে মঞ্চ নাটকের ধারাবাহিকতায়। টেলিভিশন নাটকে সেই মঞ্চের ছাপ অনেক দিন ধরেই দেখা গেছে। তারপর সেখান থেকে একটু একটু করে বের হয়ে নব্বই-এর দশকে টেলিভিশন নাটক একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’, ‘সংশপ্তক’, ‘সকাল সন্ধ্যা’ উল্লেখযোগ্য। এই কাজগুলো ছাড়াও আরও অনেক নাটক; যা ছিল তখন তুমুল জনপ্রিয়। আর এই সব নাটকের অভিনেতারা ঐ চরিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ঐ সময় পরিবার কিংবা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের রুচি ও ঐ সময়টা নির্মাতাদের কাজগুলোতে দেখতে পাওয়া যেত। তখন কাজগুলো কেবল বিনোদন দেওয়ার জন্য নির্মাণ হয়নি। সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতাও টেলিভিশন নাটকগুলোতে দেখতে পাওয়া গেছে।
টিভি নাটকে বিনোদনের নামে এখন যা নির্মাণ হচ্ছে তার বেশির ভাগ কাজই মানহীন ও কুরুচিপূর্ণ। দর্শকের দোহাই দেওয়া একধরনের মগজহীন মুনাফা লোভী মানুষ সিনেমার মত এতো বড় প্লাটফর্ম কেবল মাত্র মুনাফার মাধ্যম করে তুললও।
‘রাজাকার’ শব্দটা বলা যাবে না বলে, পাখির মুখ দিয়ে সংলাপে ‘তুই রাজাকার’ বলানো হয়েছে। আমি যে কথাগুলো বলছি তা নতুন কিছু না। এসব আমরা বারংবার পড়েছি কিংবা আমরা জানি। কিন্তু আমার বলার উদ্দেশ্যটা এই, টিভি নাটকে বিনোদনের নামে এখন যা নির্মাণ হচ্ছে তার বেশিরভাগ কাজই মানহীন ও কুরুচিপূর্ণ। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আমরা কিভাবে ঐ সুন্দর সময়টা হারিয়ে ফেললাম! তারপর কি আর কোনও নতুন চিন্তা আসেনি? নতুন কোনও অভিনেতারা তার অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর রাখেনি? আমাদের সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যায়। আর আমরা ভাবি সুদিন ফিরবে! আসল সমস্যা কিছু দুষ্ট লোকের অধিক মুনাফার লোভ। যেটা আমাদের বাংলা সিনেমায় হয়েছিল কিংবা হচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে একসময় শুধু দর্শক কি চায় কিংবা দর্শককে কি দেখতে চায়, সেই মোতাবেক নির্মাণ হয়েছিল। সেখানে দর্শকের ভবনার কোনও জায়গা রাখা হয়নি। সিনেমায় সেই রুচিহীনতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মধ্যবিত্তরা অনেক আগেই সটকে পড়েছে। বাকি দর্শকরাও এখন নিভু নিভু। তাহলে কি দাঁড়ালো? তথাকথিত দর্শকের দোহাই দেওয়া একধরনের মগজহীন মুনাফা লোভী মানুষ সিনেমার মত এতো বড় প্লাটফর্ম কেবল মাত্র মুনাফার মাধ্যম করে তুললও। এবার আবার প্রাসঙ্গিক হই।
২
দুই হাজার সাল পরবর্তী সময়ে আসি। তখন টিভি নাটকে আবার নতুন অনুসন্ধান দেখতে পাওয়া যায়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নুরুল আলম আতিক, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, আহির আলম, তার পরবর্তীতে অনিমেষ আইচ, আশুতোষ সুজন, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল এবং আমি নিজেও সেই অনুসন্ধানের একজন। সেই সময় টেলিভিশন নাটক নির্মাতাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা তাদের কাজের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। টিভি নাটকের প্রথাগত ব্লকিং এর বাইরে গিয়ে এক ধরনের সিনেমাটিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। যদিও কাজগুলো টেলিভিশনে হয়েছিল কিন্তু মানের বিচারে অনেক কাজই সিনেমা হওয়ার মত শক্তি রাখে। দর্শকও সেই নতুন সুবাস টের পেয়েছিল। ভানধরা সাজানো গল্পকে চ্যালেঞ্জ করে নির্মিত হয়েছিল বাস্তবধর্মী জীবনের গল্প। কিংবা কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়ে নির্মাণ হয়েছিল বাস্তব, পরাবাস্তব অথবা ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতা। এ সবই হয়েছিল কিছু তরুণের স্বপ্ন ভাজার ইচ্ছায়। সেই সমাজ বাস্তবতায় নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছায়। তার পরবর্তীতে আরও অনেক নির্মাতারা যোগ হয়েছিল। অনেকেই তাদেরকে অনুসরণ করেছিল। নির্মাণ হয়েছিল নানা ভাবে উল্টে পাল্টে দেখা জীবনের গল্প।
পাড়া মফস্বল গলির গল্প থেকে প্রেম কিংবা রাজনৈতিক বিদ্রূপ, কিংবা ‘যে জীবন ছিল অন্ধকারে’, সেই দগদগে গল্প টিভি পর্দায় হাজির হয়েছিল শৈল্পিক ভাবে। ‘বিকল পাখির গান’, ‘সাইকেলের ডানা’, ‘গরমভাত ও নিছক ভূতের গল্প’, ‘ফোর টুয়েন্টি’, ‘একান্নবর্তী’, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’, ‘একটা ফোন করা যাবে প্লিজ’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘যে জীবন ফড়িংয়ের’, ‘তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালবাসে’, ‘তারপর পারুলের দিন’ এরকম অসংখ্য কাহিনীচিত্র রুচির পরিবর্তন করেছিল এবং সাথে দর্শকের আগ্রহ তুলেছিল তুঙ্গে। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা কোথায় গেল? উত্তরটা পরিষ্কার, আবার দুষ্ট লোকের মুনাফার লোভ। কম টাকায় শত শত টিভি নাটক নির্মাণ করা। অথচ ভালো নির্মাণে সাপোর্ট না দেওয়া। যে কারণে ধীরে ধীরে মেধাবীরা এখান থেকে অনেকেই সরে গেলেন। তার মানে আমি এটা বলছিনা কোন অনুসন্ধান বছরের পর বছর জারি থাকে। কোনও জাগরণের পর সেটা একসময় শিথিল হয়ে পড়ে হয়তো। কিন্তু যে উত্তরণ ঘটল মাত্র দশ বছরে, এটির আরো সুন্দর অবস্থা আমরা দেখতে পেতাম।
ব্যবসা করতে আসা লোকজন কন্টেন্ট নির্মাণ করলে তার অবস্থা শোচনীয় হবেই। আর সেটা করতে গিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো সেই ফাঁদে আটকা পড়েছে। তারপরও কেউ কেউ ভাবছে কোটি কোটি ‘ভিউ’ হচ্ছে, মুনাফা হচ্ছে মন্দ কি!
এখন টিভি পর্দায় যা হচ্ছে সেখানে বুদ্ধিদীপ্ত কিছু নেই। সংলাপগুলো কুরুচিপূর্ণ। নাটকগুলোর মান হিসাবে শুধু দেখা হচ্ছে কোনটার কত ‘ভিউ’! অথচ আমি যেই কাজগুলোর কথা বললাম সেগুলোর বেশিরভাগ কাজই সেই সময়ের বিচারে সোকল্ড টিআরপিতে পিছিয়ে ছিল। কারণ সেই সময়ের তরুণেরা ‘ভিউ’ এর হিসাব করেনি।
৩
টিভি মানুষের ঘরের ভেতরের বিনোদন মাধ্যম। এরকম একটা শক্তিশালী মাধ্যম জনগণের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করার ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমরা তা না করে শুধু মুনাফা লাভের দিকে দৌঁড়েছি। এইসব আলোচনার মধ্য দিয়ে কি বোঝা যাচ্ছে আমি একগাদা অভিযোগ হাজির করলাম? আসলে এই আলাপ আরও বিভিন্ন ভাবে বলা যেতে পারে।
এতোগুলো টিভি চ্যানেল! সেখানে দক্ষ লোকজন কি আমাদের ছিল? বোঝা যায়, এই সবকিছুর ভেতরে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা আছে। বোধকরি, বিনোদন ব্যবসার সাথে রুচির যোগাযোগ থাকা জরুরি। শুধু ব্যবসা করতে আসা লোকজন কন্টেন্ট নির্মাণ করলে তার অবস্থা শোচনীয় হবেই। আর সেটা করতে গিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো সেই ফাঁদে আটকা পড়েছে। তারপরও কেউ কেউ ভাবছে কোটি কোটি ‘ভিউ’ হচ্ছে, মুনাফা হচ্ছে মন্দ কি! কিন্তু আরেকটু সৃজনশীল হতে পারলে এই বাণিজ্য আরও বড় হতো। আর আপনার রুচিহীন বিনোদন প্রসবে জাতির রুচি যে আরও তলানিতে পৌঁছে যাচ্ছে সেটা টের পেয়ে হা-রে-রে করে বলছেন আমাদের চেতনা হারিয়ে গেল!
চারপাশে যা কিছু হচ্ছে তার কিছুটা আপনার প্রসব করা মগজহীন উপস্থাপনারও কারণ। আমরা কিন্তু কোনও সহমর্মিতার গল্প হাজির করছি না। মানুষের মনের ভেতর শীতল অনুভূতির দাগ কেটে দিতে পারছি না। ভাবছিনা এবং ভাবাচ্ছিনা। আমার বিশ্বাস তারুণ্যের অনুসন্ধান থেমে থাকবে না। ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে সেই সম্ভাবনা এখন দেখা যাচ্ছে। মেধাবীরা নিশ্চয়ই তাদের কাজ দ্বারা বিকশিত হবে এবং আমাদের সময় এবং সংস্কৃতি তুলে ধরবে।
মেজবাউর রহমান সুমন ।। চলচ্চিত্র নির্মাতা